রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

৫২ বছরে সুশাসনই বড় চ্যালেঞ্জ

♦ প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক শৃঙ্খলার অভাব ♦ উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না ♦ বাড়ছে বৈষম্য

জুলকার নাইন

একাত্তরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা ও নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার পর সহায়সম্বলহীন যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিপুল জনসংখ্যার সদ্য স্বাধীন দেশটি পৃথিবীর সবচেয়ে গরিব দেশ হিসেবে চিহ্নিত ছিল। একাত্তরে ফসলের মাঠে দুই ফোঁটা পানির জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত বাংলার মানুষ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুখে সামান্য খাবার তুলে দিতে সাহায্যের ঝুলি নিয়ে ঘুরতে হয়েছে ধনী দেশগুলোর পেছনে। যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো আর শূন্য ভাণ্ডার নিয়ে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ এখন আর সেই অবস্থায় নেই। নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে শক্ত ভিত্তি করে উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশ। উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে রোল মডেলও ভাবছে বিশ্ব। কিন্তু অর্ধ শতক পেরিয়েও দেখা মেলেনি সত্যিকার সুশাসনের।

জানা যায়, ১৯৭৫-এর বিয়োগান্তক ঘটনা, একের পর এক সামরিক শাসন এবং শাসনতান্ত্রিক সংকট পেরিয়ে বিশেষ করে গত এক দশক বাংলাদেশ একের পর এক আরও বিস্ময় সৃষ্টি করে চলেছে। ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল পর্যায়ে উত্তরণ ঘটেছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রমত্তা পদ্মার বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সক্ষমতার জয়গান গাচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি, স্যানিটেশন প্রভৃতি ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশ থেকে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। শিক্ষার হারেও এগিয়েছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবার সর্বোচ্চ সম্প্রসারণ করেছে, দারিদ্র্য হ্রাসে সাফল্য পেয়েছে, বেকারত্বের হার কমিয়ে এনেছে। ক্রীড়াক্ষেত্রে বিশেষ করে ক্রিকেটে আমাদের বৈশ্বিক অর্জন প্রশংসনীয়। বিপুল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে আগামী দুই দশকের মধ্যেই বিশ্বে দাতাদেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। এই উন্নয়নও বিশ্বস্বীকৃত। অর্থনীতির আকারের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ৪১, আর ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় বিশ্বের ৩০তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রাইসওয়াটার কুপার হাউস (পিডব্লিউসি) বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৮তম বড় অর্থনীতির দেশ, ২০৫০ সালে আরও পাঁচ ধাপ এগিয়ে আসবে ২৩ নম্বরে।

দীর্ঘ দিন ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যাপনা করে আসা ড. আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শত অর্জনের পাশাপাশি আমাদের অপূর্ণতার বিষয়ও রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্ন ছিল- স্বাধীন বাংলাদেশে অন্যায়-অবিচার ও বৈষম্য থেকে আমাদের মুক্তি ঘটবে। সমৃদ্ধ, সুখী ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমাদের পথচলা মসৃণ হবে। সেদিক থেকে বিশেষ করে ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আজকের অবস্থান কোথায়, তা দেখার অবকাশ রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখানে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার বেড়েই চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে সুশাসনের অভাব প্রকট, গত কয়েক দশকে অনেকেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। আর্থিত খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা নেই। ব্যাংক বীমা থেকে সব সরকারের আমলেই হচ্ছে হরিলুট। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো এর বিচার করতে পারছে না কারণ সেগুলোতেও নেই কোনো শৃঙ্খলা। বিশ্লেষকরা বলছেন, সুশাসন নিশ্চিত করাই এখন বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ। এই সুশাসন শুধু আইনশৃঙ্খলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সামগ্রিক সুশাসনের অভাবে এখনো আসেনি প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক শৃঙ্খলা। ফলে উন্নয়নের সুফলগুলো সবার আছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। এ কারণে যে বৈষম্য দূর করতে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন সেই ধনী-গরিব ও উঁচু-নিচুর বৈষম্য এখনো বাড়ছে হু হু করে। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণায় বলা আছে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে। সুশাসন ইস্যুতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বিশ্বব্যাংকের সূচক। বিশ্বব্যাংকের এই সুশাসনের সূচকে স্থান পেয়েছে বাকস্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহিংসতার অনুপস্থিতি, সরকারের সক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর মান, আইনের শাসন এবং দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে ৪০টি উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্য। ১৯৯৬ সাল থেকে বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক অবস্থানের নির্ণায়ক হিসেবে এ সূচক প্রকাশ করে আসছে। বিশ্বব্যাংকের সূচক অনুযায়ী, বাকস্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবনতি সর্বাধিক। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ৫০ থেকে ২৬ দশমিক ৫৭-তে নেমে এসেছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহিংসতার অভাব বা সন্ত্রাসের দিক থেকেও বাংলাদেশের বড় অবনমন ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে গত ২৪ বছরে বাংলাদেশের স্কোর ২৬ দশমিক ৬০ থেকে ১৬ দশমিক শূন্য ৪-এ অবনতি ঘটেছে। সরকারের সক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ কাঠামের মান এবং দুর্নীতি দূরীকরণের স্কোরের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবনমন ঘটেছে, যদিও এ অবনমনের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত সামান্য। বঙ্গবন্ধু সরকারের সঙ্গে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা ও বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক নূরুল ইসলামের মতে, এখন দারিদ্র্য কমছে এটা ঠিক। কিন্তু এখনো ধনী-দরিদ্রের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে তা অনেক বেশি এবং এটা দিন দিন বাড়ছে। এ ছাড়াও পুরুষ-নারীর মধ্যে অনেক বৈষম্য রয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বিআইডিএসের সম্মেলনে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে এই অর্থনীতিবিদ বলেছেন, বাংলাদেশে গ্রাম ও শহরের ব্যবধান বিস্তরভাবে বাড়ছে। এ কারণে সারা দেশের মানুষ শহরে থাকতে চায়। ধনীরা আমানত কম করে। ঋণ বেশি নেয়। সেই ঋণ থেকে টাকা বাইরে পাচার করে। বৈষম্য বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বিদেশে অর্থ পাচার। এসব টাকার মালিকরা দেশে তৈরি ওই টাকার কর দিচ্ছে না। আবার দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর ঘরে বসে বিদেশে কোনো কর ছাড়াই বিনিয়োগ করা গেলে, দেশে কেন টাকা থাকবে। দেশে টাকা রাখতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করেন তিনি। দেশে দ্রুত হারে ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষণ ভালো নয় উল্লেখ করে অধ্যাপক নূরুল ইসলাম বলেন, সামগ্রিকভাবে সব পর্যায়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সঠিকভাবে ব্যাংক ঋণ বিতরণ হচ্ছে না। গ্রাম থেকে যে পরিমাণ আমানত ব্যাংকগুলো সংগ্রহ করছে, সেই পরিমাণে ঋণ গ্রামের মানুষ পাচ্ছে না। এটা সমভাবে করতে পারলে শহর ও গ্রামের সম-উন্নয়ন হতো। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী ব্যাংক ঋণের সুবিধা নিচ্ছে। এতে বৈষম্য বাড়ছে। এসব কারণে বৈষম্য বেড়ে অতি ধনীর সংখ্যা দ্রুত হারে বাড়ছে দিন দিন। এটা রোধ করার জন্য এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য সুষম অর্থনৈতিক বণ্টন ব্যবস্থাপনা দরকার। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম বলেন, বৈষম্য হচ্ছে মূলত একটি রাজনৈতিক সমস্যা। অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্বাধীন নির্ভুল নিরপেক্ষ তথ্য থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক তথ্য ছাড়া অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন অসম্ভব। আজকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে তথ্য তৈরি যৌক্তিক মনে করলেও আগামীকাল তাদেরই এ ব্যর্থতার জন্য দায়ী করা হবে।

সর্বশেষ খবর