মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

ডলার সংকট সহসা কাটছে না

বাড়তি দামে কেনাবেচা করছে ব্যাংকগুলো

শাহেদ আলী ইরশাদ

ডলার সংকট সহসা কাটছে না

আমদানির তুলনায় রপ্তানি এবং প্রবাসী আয় উল্লেখযোগ্য হারে না বাড়ায় গত বছর দেশে ডলারের যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা সহসা কাটছে না। সংকটের সুযোগে অনেক ব্যাংক বাড়তি দামে ডলার কেনাবেচা করছে। ডলার সংকট নিরসনে আগামী বাজেটে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। দাম নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানা গেছে, খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেল, সারসহ প্রয়োজনীয় জরুরি পণ্য আমদানির জন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে ৫ হাজার ৩৮৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। অন্যদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় দুই উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে না। টানা ছয় মাস পর মার্চে প্রবাসী আয় ২০০ কোটি ডলার অতিক্রম করেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অর্থনীতিতে মন্দায় পশ্চিমা দেশগুলোর বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় রপ্তানি থেকে মার্চে আয় ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ কমে ৪ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। গত রবিবার প্রকাশিত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, মার্চে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ লক্ষ্যমাত্রা থেকে আয় কমেছে সাড়ে ৭ শতাংশ। তবে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ সময়ের মধ্যে সামগ্রিক আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ শতাংশ বেড়ে ৪১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, অনেক অনিষ্পন্ন আমদানি দায় মেটানোর পাশাপাশি আমদানির ব্যাপক চাপ রয়েছে। বিদেশ থেকে নেওয়া স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধেও ব্যয় হবে অনেক অর্থ। দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে না। নির্বাচনের আগে দেশ থেকে টাকা পাচারও বেড়েছে। এসব কারণে বৈদেশিক মুদ্রা ডলার সংকট সহসাই কাটছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত এক বছরে আমদানি দায় মেটাতে প্রতি ডলারে ২৫ শতাংশের মতো দাম বেড়ে ১০৭ থেকে ১০৮ টাকায় উঠেছে। দাম নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত ১ হাজার কোটি ডলারের বেশি বিক্রি করেছে। গত অর্থবছর বিক্রি হয়েছিল ৬৬২ কোটি ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে সকল পর্যায়ে ডলারের সর্বোচ্চ দর বেঁধে দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। তবে অনেক ব্যাংক নির্ধারিত দাম মানছে না। সব ব্যাংক সর্বোচ্চ ১০৭ টাকায় রেমিট্যান্স কেনার ঘোষণা দিলেও কোনো কোনো ব্যাংক ১১৩ টাকা পর্যন্ত দরে কিনছে। বাড়তি দামে ডলার কেনায় অন্তত ১২টি ব্যাংক জড়িত। বাড়তি দামে কেনা ডলার আমদানিকারকদের কাছে ১১৪ থেকে ১১৫ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি করছে ওইসব ব্যাংক। ঘোষণার অতিরিক্ত অর্থ ব্যাংক অন্যান্য খাতে আয় কিংবা ব্যয় হিসেবে দেখাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে লেনদেন হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘ডলার বেচাকেনায় কারসাজি করা ব্যাংকগুলো পরিদর্শন করা হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে লেনদেন রোধে রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম আরও ১ টাকা বেড়েছে। গত বৃহস্পতিবার বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) রপ্তানি বিল কেনার ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম ১০৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৫ টাকা করেছে। এ দাম গত রবিবারই কার্যকর হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো ওই দিন রপ্তানি বিল কিনেছে ১০৫ টাকা করে। আমদানি খাতে ডলার বিক্রির ক্ষেত্রেও দাম বেড়েছে গড়ে ১ টাকা। বর্তমানে এ খাতে ১০৭ থেকে ১০৮ টাকা করে ডলার বিক্রি হচ্ছে। আগে ছিল ১০৫ থেকে ১০৭ টাকা।

জ্বালানি নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বিবেচনায় জ্বালানি তেল আমদানির প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ১৪ মার্চ পাঠানো চিঠিতে বিপিসি চেয়ারম্যান বলেছেন, ডলারস্বল্পতার কারণে জ্বালানি তেলের আমদানি মূল্য পরিশোধে বিলম্ব হচ্ছে। দেশের ভিতরে পরিবহন, কৃষি, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের গতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য জ্বালানি তেল। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছে বিপিসি। এদিকে ডলার সংকট নিরসনে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম ১৫ মার্চ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে বর্তমান ডলার সংকট সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের প্রস্তাব তুলে ধরেন।

রবিবার অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর দেশে কার্যরত ব্যাংক এমডিদের বলেছেন, ডলার সংকট সমাধানে আমরা সঠিক সিদ্ধান্তে আছি। অল্প কিছুদিনের মধ্যে আরও একটু সফট হবে। বৈঠকে উপস্থিত এমডিদের বাড়তি দামে ডলার কেনাবেচা করতে নিষেধ করে গভর্নর বলেছেন, পরিস্থিতি আগের চেয়ে সহজ হয়েছে, এটা ধীরে ধীরে আরও সহজ হবে।

এ বিষয়ে বেসরকারি ব্যাংক এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার বলেন, ডলার সংকট এক দিনে সমাধান হবে না এটা সবাই জানে। তবে ছয় মাস আগে যে ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন ছিল তা এখন অনেক ভালো হয়েছে। ডলার পরিস্থিতি ধীরে ধীরে সফট হচ্ছে। এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, অনেক অনিষ্পত্তিকৃত এলসি নিষ্পত্তি, আমদানির উচ্চ দায় পরিশোধ ও স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এতে বড় অঙ্কের ডলার বাইরে চলে যাবে। ফলে চলতি বছরও ডলার সংকট অব্যাহত থাকবে। ডলার সংকটের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে অর্থ পাচার। বিগত সময়ের তুলনায় নির্বাচনী বছরে অর্থ পাচার আরও বাড়তে পারে। বেসরকারি খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগে যে পরিমাণ ডলার প্রতি বছর আসত, এখন তা ব্যাপকভাবে কমে গেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর