মঙ্গলবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

যাত্রা শুরু নতুন রাষ্ট্রপতির

রফিকুল ইসলাম রনি

যাত্রা শুরু নতুন রাষ্ট্রপতির

বঙ্গভবনে গতকাল হাস্যোজ্জ্বল বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা -পিআইডি

বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হলেন মো. সাহাবুদ্দিন। গতকাল বেলা ১১টায় তিনি বঙ্গভবনের ঐতিহাসিক দরবার হলে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ নেন তিনি। তাঁকে শপথবাক্য পাঠ করান জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।

মো. সাহাবুদ্দিন ছাত্ররাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, অধ্যাপনা, সাংবাদিকতা, আইন পেশা, বিচারকের দায়িত্ব, দুদকের কমিশনারসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

গুলশানের নিজ বাসভবন থেকে বিশেষ নিরাপত্তায় বেলা ১০টা ৫৫ মিনিটে বঙ্গভবনে পৌঁছান নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। তাঁকে স্বাগত জানান বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১০টা ৫৮ মিনিটে নতুন রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে দরবার হলে প্রবেশ করেন তাঁরা। সে সময় একটি সামরিক ব্যান্ড আনুষ্ঠানিক সংগীত পরিবেশন করে। মূল মঞ্চে তিনটি চেয়ার রাখা হয়। বামপাশ থেকে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং ডানপাশে বসেন নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।

ঘড়ির কাঁটা ১১টা বাজতেই রাষ্ট্রপতির শপথ অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। শুরুতে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করা হয়। এরপর জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী নতুন রাষ্ট্রপতিকে শপথবাক্য পাঠ করান। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ অফিসের দায়িত্ব পরিবর্তনের অংশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজ নিজ আসন বদল করেন। অর্থাৎ মধ্যের আসনে বসেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। পরে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী শপথ নথিতে স্বাক্ষর করেন। রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণের পর অতিথিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

মুক্তিযোদ্ধা ও মাঠপর্যায়ের রাজনীতিবিদ মো. সাহাবুদ্দিন ২১তম রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের স্থলাভিষিক্ত হলেন। রাষ্ট্রপতি হামিদ সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে ৪১ দিনসহ টানা দুই মেয়াদে ১০ বছর ৪১ দিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে অতিবাহিত করার পর অবসরে গেলেন। গত বরিবার ছিল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের শেষ কার্যদিবস। রাষ্ট্রীয় এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য এবং শতাধিক বিশিষ্ট অতিথি উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের স্ত্রী রেবেকা সুলতানা, ছেলে আরশাদ আদনান রনিসহ পরিবারের সদস্যরা এবং বিদায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের স্ত্রী রাশিদা খানম ও ছেলে সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহমেদ তৌফিকসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। ডেপুটি স্পিকার, সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা, জাতীয় সংসদের হুইপ, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধান, কূটনৈতিক মিশনের প্রধান, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান, প্রতিমন্ত্রী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, বিভিন্ন ট্রাইব্যুনাল বা কমিশন বা ইনস্টিটিউটের প্রধান, জাতীয় রাজনৈতিক নেতা, সমাজের বিশিষ্টজন, তিন বাহিনী প্রধান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক এবং উচ্চপদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাসহ ১ হাজার ১০০ জনের বেশি আমন্ত্রিত অতিথি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে নিয়ে রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। শপথ গ্রহণ শেষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বেলা পৌনে ১২টার দিকে গুলশানের নিজ বাসায় ফিরে আসেন। পরে রাতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানিত নাগরিক বঙ্গভবনের বাসিন্দা হিসেবে ওঠেন মো. সাহাবুদ্দিন। আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে আজ সকালে নতুন রাষ্ট্রপতিকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হবে। মো. সাহাবুদ্দিন ১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর পাবনা শহরের শিবরামপুরের জুবিলী ট্যাংকপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম চুপ্পু। পিতা শরফুদ্দিন আনছারী, মাতা খায়রুন্নেসা। তিনি ১৯৭৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরে এলএলবি ও বিসিএস (বিচার) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, পাবনা জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। জেলা বাকশালের যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সাহাবুদ্দিন ছিষট্টির ৬ দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি পাবনা জেলার আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেন। ওই সময় সামরিক স্বৈরশাসকদের রোষানলে তিন বছর জেল খাটেন এবং অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। মো. সাহাবুদ্দিন দৈনিক বাংলার বাণীতে সাংবাদিকতাও করেছেন। তাঁর অনেক কলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে। কর্মজীবনে তিনি জেলা ও দায়রা জজ এবং দুদকের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। সাহাবুদ্দিন পরপর দুবার বিসিএস (বিচার) অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন। চাকরি থেকে অবসরের পর হাই কোর্টে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতার শিকার মানুষের তদন্তে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দুদক কমিশনার হিসেবে সাহাবুদ্দিন পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিরুদ্ধে ওঠা তথাকথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় দৃঢ়তার পরিচয় দেন। সাবেক এই ছাত্রনেতা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি কঠিন সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন মো. সাহাবুদ্দিন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের কিছু দিনের মধ্যেই বাংলাদেশে একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব অনেক বেশি। আর এ কারণেই সবার চোখ রাষ্ট্রপতির দিকে। আওয়ামী লীগ তো বটেই, বিএনপি, পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকরা এবং সুশীল সমাজ রাষ্ট্রপতি কোন ভূমিকা নেন, কী করেন, সে ব্যাপারে তাকিয়ে রয়েছে। মো. সাহাবুদ্দিন ইতোমধ্যেই নির্বাচনকে তিনি কী চোখে দেখেন সে ব্যাপারে একটি ইঙ্গিত করেছেন। সম্প্রতি তাঁর এক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, নির্বাচন অনেকেই মনে করছেন ক্রুশিয়াল (সংকটপূর্ণ)। কিন্তু আসলে নির্বাচন ক্রুশিয়াল (সংকটপূর্ণ) নয়। নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী। মো. সাহাবুদ্দিনকে নির্বাচন করাটা ছিল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার একটি বড় চমক। তাঁর অতীত ভূমিকা, সাহস এবং স্পষ্টবাদিতার জন্যই যে প্রধানমন্ত্রী তাঁকে পছন্দ করেছেন এটি এখন সবাই জানেন। এখন দেখার বিষয়, সামনের দিনগুলোতে তিনি কী করেন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করা বা অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া এই নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন এবং দেশের গৌরবের প্রতীক সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকাও রাষ্ট্রপতির ওপর অনেকাংশে নির্ভর করছে। কাজেই রাষ্ট্রপতির প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আগামী নির্বাচন এবং সেই চ্যালেঞ্জে তাঁকে যেমন নিরপেক্ষ থাকতে হবে তেমনি আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য যেন হয় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। এই দায়িত্ব তিনি কীভাবে পালন করবেন সেটি হলো দেখার বিষয়।

সর্বশেষ খবর