শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৪ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা
ওয়াশিংটনে প্রবাসীদের সংবর্ধনা

স্বাধীনতাবিরোধীরা আর যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে

যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি

স্বাধীনতাবিরোধীরা আর যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যারা জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, অগ্নিসন্ত্রাসী বিএনপি-জামায়াত জোট, যারা মানুষকে পেট্রলবোমা দিয়ে হত্যা করেছে, ওটা নাকি তাদের আন্দোলন! এই খুনি, অগ্নিসন্ত্রাসী, স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীরা যেন বাংলার মাটিতে আর কখনো ক্ষমতায় আসতে না পারে। এরা বাংলাদেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গিয়েছিল।’

বিশ্বব্যাংকের আমন্ত্রণে ওয়াশিংটন ডিসিতে আসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মানে ২ মে রিটজ কার্লটন মিলনায়তনে এক নাগরিক সংবর্ধনা সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, তারাই সব সময় দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। বিএনপি-জামায়াত জোট বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তথাকথিত আন্দোলনের নামে বহু মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে এবং রাস্তার পাশের হাজার হাজার গাছ উজাড় করেছে। তিনি দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, এই চক্র দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল, যেখানে আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৪ বছরে দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে একে আবারও উন্নয়নের মহাসড়কে তুলেছে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে। আমরা এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি।’ অপপ্রচারে কান না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে আমাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে, নানা কথা বলে। ডিজিটাল বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলেছি, আর সেটাই তারা সব থেকে বেশি ব্যবহার করে আমাদের বিরুদ্ধে সব সময় অপপ্রচার চালায়। অপপ্রচারে কেউ কান দেবেন না।’ বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে তাঁর সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা, বাসস্থান, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ প্রতিটি খাতের উন্নয়ন নিশ্চিত করেছে। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই আমরা এটা করতে পেরেছি।’ প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আত্মবিশ্বাস নিয়ে, আত্মমর্যাদা নিয়ে চলবেন। এই দেশ রক্ত দিয়ে আমরা স্বাধীন করেছি। এই দেশের প্রতিটা নাগরিক আত্মমর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে চলবে। শিক্ষায়-দীক্ষায় আমরা অগ্রগতি সাধন করেছি। এই অগ্রযাত্রা ধরে রেখে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। এ অবস্থায় বিএনপি-জামায়াত জোট যাতে আর ক্ষমতায় আসতে না পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘দেশের স্বার্থ ও আত্মমর্যাদা বিকিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চাই না।’ তিনি বলেন, ‘সব হারিয়ে দেশের মানুষের ভালোবাসা সমর্থন পেয়েছি। তাদের ভোটে আমি ক্ষমতায় আছি। মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। কোথায় কী ঘাটতি রয়েছে তাও আমরা নিরূপণ করে কাজ করে যাচ্ছি।’ এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলেছিলাম, করেছি। এর সুফল আপনারা পাচ্ছেন। এখানে আমার কাছে প্রয়োজনীয় ফাইল দেশ থেকে পাঠানো হচ্ছে। আমি স্বাক্ষর করে পাঠাচ্ছি। আজ সবার হাতে হাতে ফোন- এটা আমরা করেছি, যা ছিল বিএনপির এক বিদেশমন্ত্রীর একচেটিয়া ব্যবসা। মুষ্টিমেয় লোক ব্যবহার করত। কাউকে ফোন করলে ১০ টাকা, শুনলেও ১০ টাকা ছিল মিনিটে।’

দেশের সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নে বিশদ বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘৪০ লাখ টন খাদ্যের ঘাটতি নিয়ে কাজ শুরু করে আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে দেশ। মেট্রোরেল হয়েছে, কর্ণফুলী টানেল হচ্ছে, পাতালরেল হবে, কাজ চলছে। এক শত সড়ক ও এক শত সেতু একসঙ্গে উদ্বোধন করেছি এরই মধ্যে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, যাবে।’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অংশবিশেষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তিনি (বঙ্গবন্ধু) সেদিন বলেছিলেন, ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না’।” শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমিও বলি আমাদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’

স্বাধীনতার পর মাত্র তিন বছরে বঙ্গবন্ধুর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে খালি হাতে পুনর্গঠনের বিশদ বর্ণনা দেন তিনি। বলেন, জাতিসংঘ, ওআইসিসহ শতাধিক দেশের স্বীকৃতি পেয়েছিল বাংলাদেশ। সারা দেশের রাস্তাঘাট-ব্রিজ সব সংযোগ স্থাপন করেছিলেন তিনি (বঙ্গবন্ধু)। তা অনেকটা জাদুকরী কাজ বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘যারা দেশকে মেনে নেয়নি, লুট ও অগ্নিসংযোগ করে দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিল, তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিল, সেই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা, শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, পরিবারের সবাইকে হত্যা করে। সেদিন এমনকি শিশু রাসেল ও পেটের বাচ্চাও রেহাই পায়নি খুনিদের হাত থেকে।’ মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বর্তমান দাবিদারদের তিনি প্রশ্ন করেন, ‘কোথায় ছিলেন আপনারা তখন, কোথায় ছিল আপনাদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার?’ বিএনপির চোরা অবৈধ বেআইনিভাবে দল গঠনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একজন রাষ্ট্রপতি একাধারে সামরিক বাহিনীর প্রধান আবার রাষ্ট্রপতিও ছিলেন। ভোটারবিহীন হ্যাঁ-না ভোট দিয়ে তামাশা করা হয়েছে জাতির সঙ্গে নির্বাচনের নামে মানুষ ছাড়া, বন্দুকের নলে। নানা অভ্যুত্থানের নামে হাজার হাজার সেনা অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে। লাশ গুম করা হয়েছে, এমনকি পরিবারকে পর্যন্ত জানানো হয়নি কোনো কিছু। সে সময় থেকে চালু হয়েছিল বিচারহীনতার সংস্কৃতি। আমাকে হত্যা করার জন্য গ্রেনেড হামলা করা হয়েছে। আইভি রহমানসহ আমাদের অনেকেই মারা গেছেন। কেউ কেউ আজও গ্রেনেডের স্প্রিন্টারের যন্ত্রণা বহন করে চলেছে। সাজিয়ে ছিল জজ মিয়া নাটক। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘বিএনপিকে আমরা ভোটারবিহীন নির্বাচনের কারণে আন্দোলনের মাধ্যমে গদিচ্যুত করেছি। সেই বিএনপি আজ ভোটের কথা বলে কীভাবে! আমরা ভোট-ভাতের অধিকার দিয়েছি, বিচারহীনতা থেকে দেশকে উদ্ধার করেছি।’ তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হয়েছে ইনডেমনিটি আইন বাতিলের মাধ্যমে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। পালিয়ে থাকা খুনিদের মধ্যে আমেরিকায়ও একজন রয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। পদ্মা সেতুর একটি ছবি নিয়ে এসে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে দেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাদের কোনো দোষ নেই। তাদের ভুল বোঝানো হয়েছে। প্রভাবিত করা হয়েছে।’ এ প্রসঙ্গে এক সাংবাদিক ও ড. ইউনূসের কথা উল্লেখ করে তারা কীভাবে প্রভাবিত করেছেন এর বর্ণনা ও অনৈতিক মিথ্যা চাপের কথা উল্লেখ করেন তিনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শিক্ষক থেকে ব্যাংকের এমডি হওয়ার বর্ণনা দিয়ে তাঁর সরকারের আমলে নানাভাবে তাকে (ড. ইউনূস) বিরাট অঙ্কের সহযোগিতার কথা তিনি জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি আজ উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তা ভুল ছিল। গরিবের নয়, আসলে সুবিধা নিয়েছেন ব্যক্তিবিশেষ, অপকৌশলে।’ প্রবাসীদের জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘প্রবাসীদের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে টাকা পাওয়া ও মন্ত্রণালয় থেকে যথাযথ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ প্রতিটি উপজেলায় কারিগরি স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা তিনি উল্লেখ করেন। প্রবাসীদের দেশে ব্যবসার আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল করার প্রস্তাবের কথা জানান প্রধানমন্ত্রী।

দেশের উন্নয়নে প্রবাসীদের অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের উন্নয়নে প্রবাসীরা অনেক অবদান রেখেছেন।’ প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে হুন্ডির পরিবর্তে বৈধ মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সরকার যথাযথ প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স প্রেরণকে উৎসাহিত করতে ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। তিনি বলেন, কভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের পরও তাঁর সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা সম্ভব হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, চলমান যুদ্ধের কারণে উন্নতসহ অনেক দেশ সংকটে পড়লেও বহু দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা এখনো ভালো। প্রধানমন্ত্রী খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন, যেন বাংলাদেশ কোনো সংকটে না পড়ে। দেশের দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ এবং অতি দারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে কোনো চরম দারিদ্র্য থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সারা দেশে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় বিনামূল্যে বাড়ি দিয়ে আসছে। তিনি বলেন, তারা ইতোমধ্যে আবাসন প্রকল্পের আওতায় ৩৫ লাখ লোককে বাড়ি দিয়েছেন এবং তাদের জীবিকা নিশ্চিত করেছেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশে কেউ গৃহহীন থাকবে না, কারণ সরকার প্রত্যেক গৃহহীন লোককে বিনামূল্যে আবাসন প্রকল্পের আওতায় আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ এ লক্ষ্যে আরও ৬০ হাজার ঘর তৈরি হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। সমাবেশে স্বাগত ও সমাপনী বক্তব্য দেন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান। মঞ্চে উপবেশন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা এম ফজলুর রহমান এবং ডিসি আওয়ামী লীগের মো. আজাদ। অনুষ্ঠানে সারা আমেরিকা থেকে নেতা-কর্মীরা জড়ো হয়েছিলেন। এ সময় বাইরে বিএনপির বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল। শুরুতে আওয়ামী লীগের লোকজন তাদের তাড়িয়ে দিলেও পরে দাঙ্গা পুলিশের উপস্থিতিতে তারা র‌্যালি করেছেন।

সংবর্ধনা সমাবেশে শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, আসছে সেপ্টেম্বরে আবারও নিউইয়র্কে আসবেন তিনি। সে সময় আবারও দেখা হবে সবার সঙ্গে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের নেতা হিসেবে গত ১৪ বছরের মতো এবারও আসবেন- এটা নিশ্চিত করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এ সময় ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে গোটা মিলনায়তন মুখর ছিল।

সর্বশেষ খবর