রবিবার, ২৮ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

৩২৬ চরমপন্থি এখনো অধরা

♦ তিন দফায় আত্মসমর্পণ করেছে প্রায় ৩ হাজার চরমপন্থি ♦ নির্বাচন সামনে রেখে তৎপর, আতঙ্ক কমেনি ১০ জেলায়

সাখাওয়াত কাওসার

৩২৬ চরমপন্থি এখনো অধরা

চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টা। সিরাজগঞ্জের তারাশ উপজেলার ভোগলমান বাজার। শত শত লোকের সমাগম। এর মধ্যেই ১৪-১৫ জন অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্ত দেশীগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল কুদ্দুস সরকারকে উপর্যুপরি গুলি করে। কিলিং মিশন শেষ করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সময় তারা পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির লিফলেট এবং সর্বহারা পার্টি জিন্দাবাদ স্লোগান দেয়। পুলিশ পরবর্তীতে এ ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে আটজন চরমপন্থি দলের সদস্যকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে ২০০২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বেলকুচি উপজেলার রান্ধুনিবাড়ী পুলিশ ক্যাম্প থেকে লুট হওয়া ১টি এসএমজি, ১টি থ্রি-নট থ্রি রাইফেল, ১টি থ্রি নট থ্রি কাটা রাইফেল, ১১ রাউন্ড তাজা গুলি, ১টি গুলির খোসা, ২টি চাকু, ১টি সাউন্ড গ্রেনেড ও ১টি অটোভ্যান উদ্ধার করে পুলিশ।

গত বছরের ১০ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে অভয়নগরের হরিশংকরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের মাঠে ইউপি সদস্য উত্তম সরকারকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে চরমপন্থিরা। এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত আট চরমপন্থির দুজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছে, ১ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়েই উত্তমকে খুন করা হয়। পুলিশ বলছে, কথিত নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পরিচয়ে ছদ্মনাম ব্যবহার করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একের পর এক খুন ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। এসব অপরাধীর হাতে রয়েছে অস্ত্র ও গুলি। যা তারা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে ব্যবহার করছে। গত ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে পাবনা সদর উপজেলার ভাড়ারা ইউনিয়নে আতাইকান্দা ভাউডাঙ্গা মোড়ে আমিরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। দুর্বৃত্তরা চলে যাওয়ার সময় সর্বহারা দলের স্লোগান দেয়। নিহত রাজমিস্ত্রি আমিরুল সর্বহারা দলের সাবেক সদস্য বলে জানা গেছে। এত গেল মাত্র তিনটি ঘটনা। তবে চরমপন্থিরা পলাতক থেকেই মাঝে মাঝে ঘটাচ্ছে খুন, ডাকাতি এবং চাঁদাবাজির মতো ঘটনা। ভাড়াটে হিসেবে অংশ নিচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ঘটাচ্ছে ভয়ংকর অপরাধের ঘটনা। তবে গত ২১ মে ৩১৫ জন ভয়ংকর চরমপন্থি সিরাজগঞ্জে র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও অধরা রয়ে গেছে আরও ৩২৬ চরমপন্থি। বিশেষ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে চরমপন্থিদের নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলায়। চরমপন্থিদের হিসাবে রেখেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কৌশল তৈরি করছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ৬ শতাধিক সর্বহারা বা চরমপন্থি দলের সদস্য আত্মসমর্পণ করেছিল। এর আগে ১৯৯৯ সালে ২ হাজার চরমপন্থি আত্মসমর্পণ করেছিল। অভিযোগ রয়েছে, আত্মসমর্পণের কিছুদিন পর অনেকে পুনরায় চরমপন্থি দলে ফিরে গেছেন। র‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নানা নামে এসব সংগঠন চাঁদাবাজি, হত্যা, ডাকাতির মতো নানা অপরাধ করছে। গত ২০ বছরে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া এলাকায় এসব সংগঠনের হাতে ৩০০-এর বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। জানা গেছে, আত্মসমর্পণকৃত চরমপন্থিরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে জমা দিয়েছেন ২ শতাধিক ছোট-বড় আগ্নেয়াস্ত্র। আত্মসমর্পণ করা ৩১৫ জনের মধ্যে ৮৬ জনের নামে হত্যা, চারজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, দুজনের বিরুদ্ধে অগ্নিসংযোগের মামলা রয়েছে। তবে ৩১৫ জনের বিরুদ্ধে গড়ে রয়েছে ৫টি মামলা। এদের বয়স ৩৫ থেকে ৫৭ বছর। ৩৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী চরমপন্থির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এদের সবার বিরুদ্ধেই রয়েছে অস্ত্র মামলা। এরা সবাই সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, বগুড়া, কুষ্টিয়া, পাবনা ও মেহেরপুর এবং রাজবাড়ী জেলার সর্বহারা বা বিভিন্ন চরমপন্থি দলের সদস্য। এসব বাহিনীর মধ্যে রয়েছে এলএম লাল পতাকা বাহিনী, জনযুদ্ধ ও সর্বহারা পার্টির লোকজন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, যারা আত্মসমর্পণ করছেন, তাদের আর্থিক সহযোগিতা থেকে সব রকম সহায়তা করা হবে। তবে কেউ যদি মনে করেন আমরা দুর্গম এলাকায় বসে থাকব, অপরাধ করব আর আপনারা ধরতে পারবেন না, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, হত্যা, অস্ত্র এবং অগ্নিসংযোগের মামলার আসামিদের আত্মসমর্পণের জন্য খুব একটা আগ্রহ দেখানো হয় না। কারণ, এসব ক্ষেত্রে সাজা শেষ হওয়ার পরই তাদের পুনর্বাসনের আওতায় নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয় র‌্যাবের পক্ষ থেকে। প্রশিক্ষণ, আইনগত সহায়তার মাধ্যমে এই চরমপন্থিদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। তবে ৬৪১ জনের তালিকায় থাকা বাকিদের বেশির ভাগই আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছুক নন। শীর্ষ চরমপন্থি নেতারা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অবস্থান করছেন। মাঝেমধ্যে তারা গোপনে দেশে ফেরেন। টার্গেট পূরণ করে পুনরায় আত্মগোপনে চলে যান। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার লস্কলদিয়া গ্রামের রাঙ্গাতালি শেখ এবং কুষ্টিয়া জেলার গণমুক্তি ফৌজের শীর্ষ চরমপন্থি নেতা মুকুল, যশোর অভয়নগরের কথিত নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা দিপংকর। এদের সবাই ভারতে অবস্থান করেন। তবে পাবনা সদরের দুবলিয়ার মোতাহার হোসেন প্রাং নামের এক চরমপন্থি নেতা আত্মসমর্পণের ইচ্ছা পোষণ করেছেন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক র‌্যাব কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ২৫ এপ্রিল যশোরের বেনাপোলে অবৈধ অস্ত্রসহ চরমপন্থি সংগঠনের আতিয়ার রহমান (৩০) ও মহিদুল ইসলাম (৪০) নামের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশকে জানিয়েছে, ভারতে অবস্থানরত চরমপন্থি সংগঠন নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা দিপংকর বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ও গুলি সরবরাহ করে। সংগঠনের সদস্যরা এসব অস্ত্র দিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও মানুষ হত্যা করে। এদিকে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আত্মসমর্পণকৃত চরমপন্থিদের মনিটরিংয়ের মধ্যে রাখা হচ্ছে। এদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সার্বিক সহায়তা করা হবে। তবে যাদের বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ বা অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। অন্য ছোটখাটো মামলাগুলোকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় নিয়ে আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে। তিনি আরও বলেন, হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ মামলার বিষয়টি আমাদের শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম। যারা এখনো আত্মসমর্পণ করেননি তাদের কেউ কেউ নানাভাবে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরপরই সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, মেহেরপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী এলাকায় ঘাঁটি তৈরি করেছিল বামপন্থি চরমপন্থিরা। মার্কস- লেনিন বা মাওবাদী আদর্শের নামে সেই সময় ওই এলাকায় ১৫টির বেশি সংগঠন ছিল। তাদের নিজেদের মধ্যে যেমন সহিংসতা হতো, তেমনি সাধারণ অনেক মানুষ এসব বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। তবে ২০০৪ সালে র‌্যাব গঠন হওয়ার পর থেকে তারা পুরোদমে চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। সেই সময় দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোয় র‌্যাব ও পুলিশের হাতে বিভিন্ন চরমপন্থি দলের কয়েক শ সদস্য নিহত হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো- ২০০৫ সালে ঢাকা থেকে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মোফাখখার চৌধুরীর ‘ক্রসফায়ার’, ২০০৮ সালে নিষিদ্ধ সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল জনযুদ্ধ) নেতা আবদুর রশীদ মালিথা বা দাদা তপন। একই বছরে আরও নিহত হয়েছিল পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল লাল পতাকা) নেতা ডা. মিজানুর রহমান টুটুল। দীর্ঘদিন বাংলাদেশে চরমপন্থি সংগঠনগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক। তিনি বলেন, সাধারণত চরমপন্থিরা একটা আদর্শগত বিশ্বাস থেকে এ জাতীয় কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত হয়। কিন্তু সেই আদর্শগত জায়গায় এখন অনেক ভাটা পড়েছে। সেখান থেকে সরে তারা চাঁদাবাজি, খুনখারাবির মতো নানারকম অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছে, যার মাধ্যমে তারা টাকা-পয়সা অর্জন করতে পারে। এ জন্য শুধু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। কী কারণে তারা এর সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে, সেটা বের করা দরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রতিটি নির্বাচনে চরমপন্থি সংগঠনগুলো বিরাট ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে এরা বিরাট ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে এরা সরাসরি মাঠে নামে। মোটা অঙ্কের টাকার হাতবদল ও ভবিষ্যতে স্থানীয় ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রণসহ হাটবাজার, বিল-বাঁওড়ের সুযোগ-সুবিধা লাভের আশায় এসব চরমপন্থি প্রকাশ্যে মাঠে নামে। ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানাভাবে পছন্দের প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে কাজ করে। বিগত প্রতিটি নির্বাচনেই এসব অঞ্চলে চরমপন্থি-সন্ত্রাসীদের এভাবেই পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষ নিয়ে মাঠে নামতে দেখা গেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর