বুধবার, ৩১ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটির বাজেট

সংসদে উপস্থাপন কাল অধিবেশন শুরু আজ

মানিক মুনতাসির ও শাহেদ আলী ইরশাদ

৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটির বাজেট

উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বৈশ্বিক সংকট, ডলার সংকট, ব্যবসা-বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে মন্দা, জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ নানামুখী চাপ সঙ্গে করে টানা তৃতীয় (১৫ বছর) মেয়াদের শেষ বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এ বাজেটের মোট আকার হতে পারে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এ বাজেট আগামীকাল জাতীয় সংসদে ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে ডলার সংকট কাটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর বিপরীতে দেওয়া শর্ত পরিপালন করতে গিয়ে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়াচ্ছে সরকার। যার প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। এ ছাড়া ব্যাংক, আর্থিক ও রাজস্ব খাতে ব্যাপক সংস্কার আনতে হবে সরকারকে; প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে করদাতা বাড়াতে হবে।

শুধু তাই নয়, আর মাত্র ছয় মাস পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বহুমুখী চাপের মুখে এ নির্বাচন সামনে রেখে জনগণকে সামান্য হলেও স্বস্তি দিতে চায় সরকার। এজন্য সামাজিক নিরাপত্তাসহ বহুরকম নির্বাচনী কর্মসূচি থাকছে বাজেটে।

বাজেটের খসড়া ঘেঁটে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ঘাটতি ধরা হতে পারে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার। এর মধ্যে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হতে পারে ৪ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার। বিশাল আকারের রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে বাড়াতে হবে করের আওতা। এজন্য নিম্ন আয়ের মানুষকেও করের আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সরকারের একাধিক মন্ত্রী ইতোমধ্যে বলেছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) থাকলেই আয়কর রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা হতে পারে। তবে বিশ্লেষকরা এমন সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক মনে করছেন। এমন না করে বরং করযোগ্য মানুষকে করের আওতায় আনার সুষ্ঠু পরিকল্পনা করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

সূত্র জানান, প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল আগামী অর্থবছরের জন্য একটি সম্প্রসারণমূলক বাজেট প্রণয়নের; যার আকার হবে পৌনে ৮ লাখ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, অর্থবছরের শেষ দিকে এসে দেখা গেল বড় বাজেট তৈরির জন্য যে অর্থের প্রয়োজন সেই অর্থ সংকুলান করা সম্ভব হবে না। বিশেষ করে নির্বাচনী বছরের বাস্তবতার নিরিখে। কারণ এ সময় শুল্কহার বৃদ্ধি যতটা সম্ভব কম করা হবে। ফলে সরকারের জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজটি যে সংস্থাটি করে সেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষে বড় বাজেটের অর্থ জোগান দেওয়া আদৌ সম্ভব হবে না। তাই বাজেটে আকার কিছু কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু করের আওতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে উচ্চবিত্তের পাশাপাশি নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণিকেও টার্গেট করছে সরকার।

বাজেটের অঙ্ক : অর্থমন্ত্রী আগামীকাল মোট ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করতে যাচ্ছেন, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বেশি। এটি মুস্তফা কামালের অর্থমন্ত্রিত্বের পঞ্চম, আওয়ামী লীগ সরকারের ২৩তম আর দেশের ৫২তম বাজেট। ১ জুন সংসদে বাজেট প্রস্তাব পেশ করার কথা।

‘উন্নয়নের দেড় দশক : স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’ স্লোগানে বাজেট বক্তৃতায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, জাতীয় নির্বাচনের বছরে অর্থনৈতিক কার্যক্রম চাঙা করতে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের বিশাল বর্ণনা তুলে ধরবেন অর্থমন্ত্রী। আগামী অর্থবছরে ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা অনুদানসহ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা; যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে আয় করতে হবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত কর থেকে আসবে ২০ হাজার কোটি টাকা ও কর ছাড়া আয় ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা।

থাকবে বিশাল আকারের ঘাটতি : ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকার (অনুদান ছাড়া) ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেবে ৮৬ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেবে ৪৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেবে ২৩ হাজার কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেবে ১৮ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে নেবে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা। নিট বৈদেশিক ঋণ নেবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

প্রতিশ্রুতি : আগামী অর্থবছরে সরকার দেশের উন্নয়নে ব্যয় করবে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় হবে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বহির্ভূত প্রকল্পে ব্যয় করবে ৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে ব্যয় হবে ২ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। বিভিন্ন স্কিমে ব্যয় করবে ৩ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা।

আগামী বাজেটের রূপরেখায় সরকারের পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা; যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৩ শতাংশ বা ৬০ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকার বেশি। পরিচালন ব্যয়ের হিসাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ বাড়ছে ৩৫ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা।

সংকট সত্ত্বেও উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য : আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা; যা চলতি অর্থবছরের বাজেটে সংশোধিত জিডিপির চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির পরিমাণ রয়েছে ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বৈশ্বিক সংকটেও এ উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশা করছে সরকার। যদিও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ উন্নয়ন সহযোগীরা বলছে, বৈশ্বিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আগের তুলনায় হ্রাস পাবে।

মূল্যস্ফীতি শতাংশ ধরে রাখার চেষ্টা : টানা প্রায় দেড় বছর ধরে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে ফেলেছে; যা এখন প্রায় ২ অঙ্কের ঘর ছুঁইছুঁই। মূল্যস্ফীতির এ চাপকে ৬ শতাংশে ধরে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে আগামী বাজেটে।

করের আওতা : আইএমএফের শর্তানুযায়ী প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে করদাতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া ২০২৬ সালে মধ্যে দেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চূড়ান্ত উত্তরণের জন্য আরও কিছু বাধ্যবাধকতাও মানতে হবে; যার বহুমুখী প্রভাব হিসেবে জনগণের ঘাড়ে করের চাপ বাড়বে। এদিকে এনআইডি কার্ডের অধিকারী সবাইকে করের আওতায় আনার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। তবে যাদের টিআইএন রয়েছে এমন ব্যক্তিদের সবাইকে ন্যূনতম ২ হাজার টাকা হারে আয়কর প্রদানও বাধ্যতামূলক করা হতে পারে আসছে বাজেটে।

শর্তের প্রতিফলন : ৪ দশমিক ৭ বিলিয়র ডলার ঋণের বিপরীতে দেওয়া ৩৮ রকমের শর্তারোপ করেছে আইএমএফ। এর ফলস্বরূপ ইতোমধ্যে একাধিক বার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বাজেটের পর খুবই কম সময়ের মধ্যে আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণাও আসতে পারে। এ ছাড়া ব্যাংক খাতের খেলাপি কমানো ও আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা আনতে এ খাতে আরও কয়েকটি সংস্কার আনতে হবে সরকারকে। বিশেষ করে রাজস্ব বাড়াতে এ খাতে সংস্কার আনতে হবে আগামী বাজেট থেকেই। অবশ্য চলতি বাজেটেও ওসব শর্তের প্রতিফলক ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

একাদশ জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হচ্ছে আজ : একাদশ জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হচ্ছে আজ। বিকাল ৫টায় সংসদের বৈঠক শুরু হবে। জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হবে। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের ধারা (১) অনুযায়ী তাঁকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সংসদের ২৩তম অধিবেশন আহ্বান করেন। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল আগামীকাল ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করবেন। জুন মাসের শেষ দিকে কোরবানির ঈদ থাকায় এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা আগেভাগেই বাজেট পাস হবে। সে কারণে এ বছর বাজেট পেশও কিছুটা আগে হচ্ছে। আগামী ২৫ জুন সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট পাস হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সংসদ অধিবেশন শুরুর দিনই বিকাল ৪টায় অনুষ্ঠেয় সংসদের কার্যউপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি বজায় রাখার লক্ষ্যে সম্ভাব্য বাজেটের আকার হবে ৭৬১,৭৮৫ কোটি টাকা। সরকার এই সময় আগামী অর্থবছরে ৭.৫% প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের লক্ষ্য রেখেছে, যেখানে প্রায় ৬.৫% মূল্যস্ফীতি। আগামী বছর মোট বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা হবে জিডিপির ৩৩.৮ শতাংশ।

সর্বশেষ খবর