মঙ্গলবার, ৮ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

আবারও নালায় ডুবে কলেজছাত্রীর মৃত্যু

তলিয়েছে চট্টগ্রামের ৪৫ শতাংশ, বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অসহায় মানুষ

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

আবারও নালায় ডুবে কলেজছাত্রীর মৃত্যু

চট্টগ্রাম শহর কয়েকদিন ধরেই পানিতে থইথই। জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত -বাংলাদেশ প্রতিদিন

এখনো পানিতে ডুবে আছে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। জলাবদ্ধতায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে বন্দর নগরীর বিপুলসংখ্যক মানুষ। চার দিনের টানা বৃষ্টিতে ডুবেছে নগরীর কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ এলাকা। এরই মধ্যে আবারও নালায় ডুবে এক কলেজছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। নগরীর পাহাড়তলী ইসলামিয়াহাট এলাকায় খোলা নালায় পড়ে নিপা পালিত নামে এই কলেজছাত্রীর মৃত্যু হয়। গতকাল সকালে এ দুর্ঘটনা ঘটে। স্থানীয় উত্তম পালিতের মেয়ে নিপা পালিত হাটহাজারী সরকারি কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সকালে পরীক্ষা দিতে কলেজে যাচ্ছিলেন ওই শিক্ষার্থী। যাওয়ার পথে মাথা ঘুরে পানিতে ডুবে থাকা নালায় পড়ে আর ওপরে উঠতে পারেননি। দীর্ঘদিন ধরে মৃগী রোগে ভুগছিলেন তিনি। নিমজ্জিত চট্টগ্রামকে অভিভাবকহীন নগরী হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করে জলাবদ্ধতা নিরসনে দ্রুত কার্যকর পদ্ধক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন নগরবাসী। এদিকে বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে অলিগলি, রাস্তাঘাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টা ডুবে থাকায় অসহনীয় কষ্টে পড়েছেন নগরীর লাখ লাখ অধিবাসী। এতে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন দেশের অন্যতম পাইকার বাজার খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ফুটপাতের দোকানদার। জলাবদ্ধতার জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) একে অপরকে দূষছে। তবে এমন পরিস্থিতির জন্য দুই সংস্থাকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধানরা জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে বলতে গেলে অনভিজ্ঞ। তাদের এ বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। ফলে জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর কোনো পদপক্ষেপ নিতে পারছেন না তারা। তাদের অনভিজ্ঞতার কারণেই চট্টগ্রামবাসী হাঁটু পানি থেকে কোমর সমান পানিতে ডুবে কষ্ট পাচ্ছেন।’

জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন চেয়ে গতকাল যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী। তারা যৌথ বিবৃতিতে বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। যাতে জনগণ সহসা প্রকল্পগুলোর সুফল পায়। পারস্পরিক দোষারোপের বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতে হবে, যাতে কোনোভাবেই উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যাহত না হয়। চার দিন ধরে পানির নিচে থাকাটা দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার ফল হিসেবে দেখছেন নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোওয়ার হোসেন মজুমদার। তিনি বলেন, নগরে প্রতি দিনই মানুষ বাড়ছে। কিন্তু বিপরীতে ভরাট হচ্ছে ড্রেন, দখল হচ্ছে খাল। এসব কারণে চরমভাবে সংকুচিত হচ্ছে পানি ধারণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা। ফলে দিন দিন প্রকট হচ্ছে জলাবদ্ধতা। টানা ভারী বৃষ্টিতে পানিতে ভাসছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। গত চার দিনের ভারী বর্ষণের ফলে নগরীর বেশির ভাগ এলাকা ডুবে গেছে। বৃষ্টির পানি খাল-ছড়া, নালা, সড়ক ছাড়িয়ে ঢুকে গেছে অলিগলিতেও। নগরীর নিম্নাঞ্চল, নিচু এলাকাগুলোর ভবন, বাসাবাড়ি, অফিসেও পানি ঢুকেছে। ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে লোকজন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসভবনও কোমর পানিতে ডুবে যায়। এতে ঘরবন্দি হয়ে পড়েন নগর পিতা ও তার পরিবার। সড়কে হাঁটু থেকে বুকসমান পানিতে ডুবে যাওয়ায় দিনের বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকছে যান চলাচল। এতে দেখা দিয়েছে পরিবহন সংকট। এ সুযোগে বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ ওঠে রিকশা-অটোরিকশা চালকদের বিরুদ্ধে। নগরীর বিভিন্ন এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। নগরী পানিবন্দি হওয়ায় প্রভাব পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। পাইকারি বাজার থেকে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ তুলনামূলক কম রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও গোডাউন ডুবে যাওয়ায় কোটি কোটি টাকার লোকসানে পড়েছেন ক্ষুদ্র থেকে বড় ব্যবসায়ীরা। গতকাল সরেজমিন চকবাজার, কাপোসগোলা, বহদ্দারহাট এবং মুরাদপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জলজটের কারণে পুরো সড়কই নদীতে পরিণত হয়েছে। এলাকার সড়কগুলো হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে গেছে। মোটরচালিত গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে পড়ায় বিকল হয়ে যায় অসংখ্য গাড়ি। টানা বৃষ্টিতে নগরের বাকলিয়া ডিসি রোড, নাসিরাবাদ, ষোলোশহর ২ নম্বর গেট, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, অক্সিজেন, চান্দগাঁও, কাতালগঞ্জ, বাকলিয়া, আগ্রাবাদ, হালিশহর, ছোটপোল, মুন্সিপুকুর পাড়, সল্টগোলা, ইপিজেড, আনন্দবাজার, শান্তিবাগ আবাসিক, হাজিপাড়া, রিয়াজউদ্দিন বাজার, সিডিএ আবাসিক এলাকাসহ নগরের বিভিন্ন এলাকা পানিতে ডুবছে। কোথাও কোমর পানি, আবার কোথাও রয়েছে বুকসমান পানি। ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে নগরীর প্রায় ৪৫ শতাংশ এলাকায় প্রতিদিনই ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টা ডুবে থাকছে। এতে লাখ লাখ নগরবাসী পড়েছেন চরম বেকায়দায়। নগরী ছাড়াও চট্টগ্রাম হাটহাজারী, সীতাকুণ্ড, রাউজান, পটিয়া, বাঁশখালীসহ অনেক উপজেলার কিছু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর অনেক এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। এরই মধ্যে নগরীতে ৯৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে লোকজনের জন্য শুকনা খাবার ও ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলার অনেক উপজেলার লোকজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ওই এলাকায় চাল, শুকনা খাবার দেওয়া হচ্ছে।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘সিটি করপোরেশন বর্ষার আগে সঠিকভাবে নালা-নর্দমা পরিষ্কার করেনি। নতুন খালটি খনন করতে পারেনি। তাই নগরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ফলে মানুষ জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না।’ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত কয়েক দিন যেভাবে ভারী বৃষ্টি হয়েছে তাতে কোনো সংস্থার কিছু করার নেই। এরকম বৃষ্টি হলে পৃথিবীর যে কোনো উন্নত দেশে এ ধরনের জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতো। জলাবদ্ধতা নিসরণে নেওয়া প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরিত্রাণ মিলছে না।

চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ জহিরুল ইসলাম জানান, মৌসুমি বায়ু, খ মেঘ এবং সমুদ্রে বায়ুর চাপের আধিক্যের কারণে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আরও দুই থেকে তিন দিন এমন ভারী বর্ষণ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বৃষ্টিপাতের কারণে চট্টগ্রামে বিভাগে ভূমিধসের শঙ্কা রয়েছে।

মেগা প্রকল্পেও মিলছে না সুফল : চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ১১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয় তিন সংস্থা। যার মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একটি, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) দুটি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) একটি প্রকল্প। এরই মধ্যে এ প্রকল্পগুলোয় ছয় বছরে ৫ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু তারপরও সুফল মিলছে না। জোয়ার ঠেকাতে নগরের বিভিন্ন খালের মুখে ৪০টি স্লুইসগেট নির্মাণের কথা থাকলেও ছয় বছরে মাত্র পাঁচটি নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৩৫টি স্লুইসগেটের কাজ এখনো শেষ হয়নি। জলাবদ্ধতা প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ না হওয়ায় এবং স্লুইসগেট নির্মাণ শেষ না হওয়ায় অল্প বৃষ্টিতেই হাঁটু পানি থেকে গলা পানিতে ডুবে যায় নগরীর বেশির ভাগ এলাকা। অথচ চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনর্খনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকার একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। বর্তমানে প্রকল্পের অগ্রগতি প্রায় ৭৭ শতাংশ। ২ হাজার ৭৪৬ কোটি ৩৯ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল’ পর্যন্ত সাড়ে আট কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করছে আরেক প্রকল্প। তিন দফায় মেয়াদ বাড়ানো হলেও এখনো শেষ হয়নি প্রকল্পটির কাজ। বহদ্দারহাট বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন একটি খাল খননের জন্য ২০১৪ সালে উদ্যোগ নেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। চার দফা সংশোধনের পর ৩৫৭ কোটি টাকার প্রকল্পটির ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রকল্পটি ভূমি অধিগ্রহণের মধ্যে আটকে আছে। ‘চট্টগ্রাম মহানগরের বন্যানিয়ন্ত্রণ জলাবদ্ধতা নিষ্কাশন উন্নয়ন’ শীর্ষক ১ হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ২০২০ সালের শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ২৫ শতাংশ। সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘সিডিএর নেওয়া একটি প্রকল্প আগামী বর্ষার আগে শেষ হবে। তখন জলাবদ্ধতা কিছুটা কমবে। আরেকটা প্রকল্প শেষ হতে আরও দেড় বছর সময় লাগবে।’ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ না হওয়ায় পর্যন্ত জলাবদ্ধতা থেকে নিস্তার মিলছে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি নালা-নর্দমা পরিষ্কার করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার।’

সর্বশেষ খবর