শুক্রবার, ২৪ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

সীমান্তে এক ভয়ংকর শাহিন

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি

ভারতের কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যায় জড়িত মাস্টারমাইন্ড হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র শহিদুল ইসলাম সেলিমের আপন ছোটভাই আক্তারুজ্জামান শাহিন। গতকাল দুুপুরে শাহীনের কোটচাঁদপুর পৌরসভার পাশে পৈতৃক বাড়ির সামনে ফাঁসির দাবিতে এলাকাবাসী বিক্ষোভ করেছেন। এদিকে শাহিনের অগাধ সম্পদ নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা রহস্য।

জানা গেছে, ব্যবসায়িক লেনদেন নিয়ে বিরোধের জেরে বেয়াই সৈয়দ আমানুল্লাহ সাঈদ ওরফে আমানকে নিয়ে শাহিন কলকাতায় তার বাল্যবন্ধু আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। সুন্দরী নারী শিলাস্তি রহমানকে দিয়ে ফাঁদ পেতে তাকে ভারতে নিয়ে যান। আনারের বিরুদ্ধে থাকা আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন শাহিন এবং আমানুল্লাহ। কলকাতার ব্যারাকপুরের যে ফ্ল্যাটে আনারকে হত্যা করা হয়, সেটির মালিকও শাহিন। মিশন সফল করার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে দেশে ফিরে গ্রেফতার হয়েছেন তাঁর বেয়াই সৈয়দ আমানুল্লাহ সাঈদ ওরফে আমান। তার বাড়ি খুলনার ফুলতলা এলাকায়।

শাহীনরা তিন ভাই ও দুই বোন। মেজো ভাই প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। শাহিন কোটচাঁদপুরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ১৯৮৭ সালে চট্টগ্রামে মেরিন একাডেমিতে পড়াশোনাকালীন ডিভি লটারিতে আমেরিকায় চলে যান। ঢাকায় ফিরে বরিশালের এক মেয়েকে বিয়ে করেন। শাহিনের একটি ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তারা এখন আমেরিকায় বসবাস করে। তিনি আমেরিকায় পাড়ি জমালেও নিয়মিত দেশে আসতেন। এরপরই বাল্যবন্ধু আনারের হাত ধরে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে শাহিন। একপর্যায়ে জড়িয়ে পড়েন চোরাচালানে। অবৈধ এ ব্যবসার জোরে বাংলাদেশ ও ভারতে গড়ে তোলেন সাম্রাজ্য। শাহীন কোটচাঁদপুরের গ্রামের বাড়ি এলাঙ্গী ইউনিয়নের একটি দুর্গম এলাকায় গড়েছেন ৩০ বিঘা জমির ওপর বিশাল বাগানবাড়ি ও রিসোর্ট। সুউচ্চ প্রাচীরঘেরা ও সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরার বেষ্টনী। পাহারায় রয়েছে বাহারি রকমের বিদেশি বেশ কয়েকটি কুকুর। বাড়িতে প্রায়ই অতিথি হয়ে আসতেন সরকারি উচ্চ পদস্ত কর্মকর্তা, বড় বড় ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও নায়িকা। সেখানে বিভিন্ন সময় তাদের নিয়ে মাস্তি করতেন। কোটচাঁদপুর থানায় যে পুলিশ কর্মকর্তাই আসুক না কেন শাহিন তাকে বধ করতেন। বাদ যায়নি কোটচাঁদপুর থানার বর্তমান ওসি সৈয়দ আল মামুন। তিনি শাহীনের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা করিয়ে দিতেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব কারণে শাহিন এলাকার ডন হিসেবে পরিচিতি পান। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শাহিন নিজে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করলেও অবৈধ ব্যবসার কারণে ঘন ঘন এলাকায় আসতেন এবং সালিশ-দরবার করতেন। সেখানে তার রায়ই চূড়ান্ত হতো। কেউ বিরোধিতা করলে পুলিশ দিয়ে তাকে হয়রানি করার অভিযোগও রয়েছে। তবে শাহিন এতটাই প্রভাবশালী, তার বিরুদ্ধে থানা-পুলিশে অভিযোগ দিয়েও লাভ হয় না। কোটচাঁদপুর এলাকার বেশ কয়েকজন জানান, মানুষ তার আয়েব উৎস সম্পর্কে কিছু জানতে না পারলেও শাহিন গত দেড় দশকে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। অবশ্য এলাকায় দুই হাতে তিনি পয়সা খরচ করেন বলেও জানান অনেকে। শাহিন যেভাবে দুই হাতে টাকা বিলান, তাতে শত কোটি টাকার মালিক ছাড়া সম্ভব নয়। স্থানীয়রা জানান, এমপি আনার খুনে শাহিনের নাম উঠে আসায় অবাক হননি তারা। কারণ কোটচাঁদপুরে ব্যাটারিচালিত যানবাহনের স্ট্যান্ড দখল নিয়ে বছর তিনেক আগে তার অনুসারীরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পরে শাহিনের নামে অভিযোগ হলেও সহজে পার পেয়ে যান তিনি। এ ব্যাপারে শাহিনের ভাই কোটচাঁদপুর পৌর মেয়র সহিদুল ইসলাম সেলিম জানান, কোনো হত্যাই সমর্থনযোগ্য না বা আমরা বিশ্বাসও করি না। ক্ষমতাসীন দলের এমপি আনার হত্যায় আমার ভাই যদি জড়িত থাকে তাহলে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে তার বিচার হোক। এতে আমার কোনো বাধা থাকবে না। তার কাছে ভাই শাহিনের সঙ্গে সর্বশেষ কবে যোগাযোগ হয়েছে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ৭-৮ দিন আগে মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে। কী কথা হয়েছে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার কাছ থেকে শাহিন ১ লাখ টাকা ধার নিয়েছিল। ওই টাকাটা কখন কীভাবে দেবে এই কথা হয়েছে। শাহিনের সঙ্গে কোটচাঁদপুর থানার ওসি সৈয়দ আল মামুনের ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারে ওসির কাছে ফোন দিয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে ফোন কেটে দেন। শাহিনের বাড়িতে মদের কারখানা : শাহিনের বাড়িতে একটি মদের কারাখানা রয়েছে। সেই ভিডিও বর্তমানে ভাইরাল হয়েছে। তবে কোনো সমর্থিত সূত্র নিশ্চিত করতে পারেনি। ভিডিওতে বাড়ির ভিতরে দেখা গেছে বিভিন্ন রুমে মদের বোতল ও মদ তৈরির সরঞ্জাম। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কারখানাটিতে অভিযান চালানোর সংবাদ পাওয়া যায়নি।

এমপি আনারের লাশ দেখার অপেক্ষায় নেতা-কর্মীরা : আনারের লাশ আসার অপেক্ষায় রয়েছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। বুধবার ও বৃহস্পতিবার (গতকাল) দুই দিন কালীগঞ্জ ভূষণ সড়কে এমপি আনারের বাড়ির সামনে ভিড় করছেন জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দলীয় নেতা-কর্মীরা। অনেকে প্রিয় নেতার জন্য কান্নাকাটি করছেন। আনারের স্বজনদের চোখের পানি ফুরাচ্ছে না। রাখালগাছী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইউপি চেয়ারম্যান মহিদুল ইসলাম বলেন, এমপি মহোদয়ের মৃত্যুর খবরে আমরা স্তব্ধ হয়ে পড়েছি। এলাকাবাসীর একটাই দাবি, তার লাশ দ্রুত দেশে এনে আমাদের দেখার সুযোগ করে দেওয়া হোক। কালীগঞ্জ সরকারি মাহতাবউদ্দিন ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক সুব্রত কুমার নন্দী বলেন, আনার ভাই অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। তার মতো একজন ব্যক্তিকে সন্ত্রাসীরা এভাবে কেন হত্যা করল? এটা বুঝে উঠতে পারি না। এমপি আনারের ভাই ইমান আলী বলেন, আমার ভাইয়ের লাশ দ্রুত দেশে এনে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক। কালীগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পৌর মেয়র আশরাফুল আলম বলেন, আমরা এখন আর কিছুই চাচ্ছি না। শুধু একটাই চাওয়া এমপি মহোদয়ের লাশ অতি দ্রুত আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। অন্তত তার মৃত মুখটা যাতে দেখতে পারি।

ভারতের ভিসা পাননি এমপি পরিবার : ভারতের ভিসার আবেদন করেছিলেন এমপি কন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন, আনারের স্ত্রী শেফালী বেগম ও পিএস আবদুর রউফ। তারা ভারতে আনারের লাশের সন্ধানে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার পর্যন্ত (গতকাল) তাদের ভিসা দেওয়া হয়নি।

বাবাকে নিয়ে এমপি আনারের কন্যার আবেগঘন স্ট্যাটাস : আনারের মৃত্যুতে মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বাবাকে নিয়ে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। বুধবার রাত ১০টায় ও বৃহস্পতিবার (গতকাল) সকাল সাড়ে ৬টার দিকে তার ভেরিফায়েড ফেসবুকে আবেগঘন দুটি পোস্ট করেন। প্রথম পোস্টে ডরিন লেখেন ‘আব্বু তোমার অনেক কষ্ট হয়েছিল তাই না? তুমি তো আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলে, আমিই যাইনি। ভিসা ছিল না আমার। আমি তোমার কষ্টের ভাগ নিতে পারলাম না। তুমি কত কষ্ট পেয়েছ, এটা ভাবলে আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি তোমার এত আঘাত-ব্যথা সহ্য করতে পারি না। আল্লাহ কি নেই? এত কষ্ট দিয়ে কোনো মানুষ মানুষকে মারতে পারে বলে আমার জানা ছিল না। আমি বিচার চাই, আমি বিচার চাই। আমি ওদের লাশ দেখতে চাই নির্মমভাবে।’ বৃহস্পতিবার সকালের পোস্টে তিনি লেখেন, ‘আমি আব্বু ডাকতে পারি না। আমি তো এতিম। তুমি কি দেখতেছো আব্বু?’ এ ছাড়া বুধবার বিকাল সোয়া ৩টার দিকে এক স্ট্যাটাসে ডরিন লিখেছিলেন, ‘আমি আমার বাবার হত্যার বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, ধৈর্য ধরো বিচার হবে।’ এর আগে দুপুরে ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ডরিন বলেন, বাবাকে যারা হত্যা করেছে, তাদের ফাঁসি চাই। যারা বাবাকে হত্যা করেছে, তাদের আমি দেখতে চাই।

সর্বশেষ খবর