রবিবার, ২৬ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা
ভারতে খুন এমপি আনার

হত্যার কারণ এখনো অজানা

অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলছে না, লাশ উদ্ধার না হওয়ায় খুনের মামলাও হচ্ছে না, কলকাতায় খালে জাল ফেলে সন্ধান, দুবার কিলিং মিশন ব্যর্থ হয় বলছে ডিবি

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও কলকাতা প্রতিনিধি

হত্যার কারণ এখনো অজানা

ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের নিখোঁজের ঘটনা নিয়ে অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি হলেও মিলছে না কোনো উত্তর। এমপি আনার খুন হয়েছেন পুলিশ দাবি করলেও লাশ এখনো উদ্ধার হয়নি। যে কারণে হত্যা মামলাও করা সম্ভব হয়নি। খুনের কারণ এখনো পুলিশের কাছে অজানা। এসব বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানিয়েছেন, ডিবির একটি দল রবিবার (আজ) ঘটনাস্থল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যাত্রা করবে। হয়তো সেখান থেকেই অনেক প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে। এদিকে কলকাতার ভাঙ্গড়ে কৃষ্ণ মাটি খালে জাল ফেলে এমপি আনারের লাশের টুকরোর খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।

ভারতের দুই সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসে ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করছেন গ্রেফতারকৃতদের। বাংলাদেশ পুলিশের তিন সদস্যের একটি দল আজ ভারত যাচ্ছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গতকাল জানান, আনোয়ারুল আজিম আনারকে আরও দুবার খুনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে এবং চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে এ খুনের পরিকল্পনা করা হয়। তিনি বলেন, দুবারের পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়ে তৃতীয়বারের পরিকল্পনায় কলকাতায় তাকে খুন করা হয়। এ ঘটনায় তার (হারুন অর রশীদ) নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল কলকাতায় যাবে। সেখানে তারা এ হত্যাকান্ড নিয়ে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যগুলো যাচাইবাছাই ও অনুসন্ধান করবে।

হারুন অর রশীদ বলেন, মূল পরিকল্পনা ছিল এমপিকে হত্যা করা। তবে এর আগে তারা (খুনিরা) চেয়েছিল কলকাতার সেই ফ্ল্যাটে নিয়ে তাকে দুই দিন রেখে ব্ল্যাকমেল করে কিছু টাকা আদায় করতে। কিন্তু অতিরিক্ত চেতনানাশক প্রয়োগের কারণে চেতনা না-ফেরায় তাকে খুন করা হয়। এরপর খুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সংসদ সদস্যের মুঠোফোন নিয়ে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সবাইকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।

জানা গেছে, ভারতের বিধাননগরের নিউটাউন থানা এবং বাংলাদেশের শেরেবাংলা নগর থানায় এমপি আনারের নিখোঁজের ঘটনায় দুটি অপহরণ মামলা হয়েছে। তিনি খুন হয়েছেন বলে দাবি করা হলেও গতকাল পর্যন্ত এমপি আনারের লাশ কিংবা এর কোনো খন্ডিতাংশই পাওয়া যায়নি। প্রকৃতপক্ষেই তিনি খুন হয়েছেন নাকি এখনো অপহৃত কিংবা কোথাও জিম্মি হয়ে আছেন তা এখনো অস্পষ্ট।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি হত্যা মামলা হলে মৃত ব্যক্তির মৃত্যু সনদ প্রয়োজন হয়। মামলার অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তাকে লাশ না পাওয়া গেলেও মৃতদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ অর্থাৎ মাথার খুলি, কলিজা, পাঁজর-মেরুদন্ডের হাঁড়ের ডিএনএ প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করতে হয়। কারণ, পা, হাত কিংবা চোখ ছাড়াও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। অনেকেই বেঁচে আছেন দীর্ঘদিন ধরে। এমপি আনার যদি খুন হয়ে থাকেন তার ক্ষেত্রে এসব বিষয় প্রযোজ্য হবে অভিযোগ প্রমাণের জন্য।

জানা গেছে, স্পর্শকাতর এবং দুই দেশের বহুল আলোচিত বিষয়টি ফলো করছেন এমন অনেক বিশেষজ্ঞ নানা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন। তারা বলছেন, অপরাধীরা সাধারণত নিজের অপরাধ সংঘটনের জন্য নিজের বাসাকে বেছে নেয় না। সেক্ষেত্রে প্রধান সন্দেহভাজন আক্তারুজ্জামান শাহিন হানিট্র্যাপের সহায়তা নিয়ে গাজীপুরে তার নিজের বাগানবাড়িকেও বেছে নিতে পারতেন। কারণ অভিজাত সঞ্জীবা গার্ডেন অ্যাপার্টমেন্টের প্রবেশপথসহ অনেক স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরার বিষয়টি অপরাধীরা জানতেন।

কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন, শাহিনের ভাড়া করা এই অত্যাধুনিক ‘ট্রিপ্লেক্স’ ফ্ল্যাটের নিচের ফ্লোরের মানুষ হাড় কোপানোর কোনো শব্দই কেন পেলেন না? অনেকে বলছেন, ভয়ংকর এ কান্ডে স্থানীয় কারও সহায়তা ছাড়া কীভাবে সম্ভব? এমপি আনারের ওজন অন্তত ৮০ কেজি। এমন ওজনের একজনের মৃতদেহ টুকরো টুকরো করলেও অন্তত পাঁচটি লাগেজের প্রয়োজন। প্রশ্ন উঠছে, ভারতে বর্তমানে নির্বাচন চলছে। তাই সেখানে যাওয়ার পর একজন আইনপ্রণেতা হিসেবে এমপি আনার নজরদারির মধ্যে থাকার কথা ছিল। এমপি পরিচয়ের বাইরে যেহেতু তিনি একজন চোরাই সোনা এবং হুন্ডি ব্যবসায়ী। চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার আগে তার জাতীয় সংসদের অনুমতি নেওয়ার কথা ছিল। কারণ তার চিকিৎসার সমুদয় খরচ রাষ্ট্রের বহন করার বিধান রয়েছে। এমপি আনার নিখোঁজের ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন এবং মাস্টারমাইন্ড হিসেবে চিহ্নিত আক্তারুজ্জামান শাহিনও একজন চোরাকারবারি এবং হুন্ডি ব্যবসায়ী। তার নাম ভারতীয় গোয়েন্দাদের খাতায়ও থাকার কথা। সূত্রমতে, কলকাতার গোপাল বিশ্বাসের কাছে এমপি আনারের মোবাইল থেকে আসা খুদেবার্তাটিও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের বক্তব্য নিয়েও নানা আলোচনা হচ্ছে। শুরুতে তিনি বলেছিলেন, তিনি ভারতে গেছেন। সময়মতো চলে আসবেন। তার মোবাইল ফোনের অবস্থান মুজাফ্ফরাবাদে।

কলকাতা প্রতিনিধি দীপক দেবনাথ জানান, কলকাতায় খুন হওয়া ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের লাশের টুকরোর সন্ধান পেতে আরও জোরদার করা হলো তল্লাশি অভিযান।

আনার হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত সন্দেহভাজন ব্যক্তি কসাই জিহাদ হাওলাদারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই জানা যায় ভাঙ্গড়ের কৃষ্ণমাটি এলাকায় সেই লাশের টুকরো ফেলে দেওয়া হয়েছিল। তারপর বৃহস্পতিবার রাত থেকে গত দুই দিন ধরে দফায় দফায় চলছে তল্লাশি অভিযান। এরই মধ্যে শুক্রবার বিকালে জিহাদকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি অভিযান চালানো হয়। কৃষ্ণমাটি এলাকার জিরানগাছা বাগজোলা খালের পানিতে নামানো হয় কলকাতা পুলিশের দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যদের। কিন্তু তারপরও খুঁজে পাওয়া যায়নি সেই লাশের টুকরো।

আর এবার সেই লাশের সন্ধান পেতে ওই খালে জাল ফেলা হয়। সঙ্গে নামানো হয় নৌকাও। এদিন স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে শুরু হয় তল্লাশি অভিযান। এখনো পর্যন্ত সফলতা পাননি তদন্ত কর্মকর্তারা।

পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের গোয়েন্দা দফতর সিআইডি সূত্রে জানা যায়- গ্রেফতারকৃত কসাই জিহাদকে সঙ্গে নিয়ে নিউটাউনের সেই অভিজাত সঞ্জীবা আবাসনের ‘বিইউ-৫৬’ ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে গিয়ে খুনের ঘটনার পুনর্নির্বাণ করতে পারে। শুক্রবারই কসাই জিহাদ হাওলাদারকে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাসত জেলা ও দায়রা আদালতে তোলা হলে ১২ দিনের সিআইডি হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁর গোপালনগর এলাকা থেকে জিহাদকে গ্রেফতার করে সিআইডি। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ভারতীয় দন্ডবিধির ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ।), ৩০২ (অপরাধমূলক নরহত্যা।), ২০১ (তথ্যপ্রমাণ লোপাট) এবং ১২০বি (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র)- এই চার জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর