আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তারই অংশ হিসেবে প্রশাসনে আমূল পরিবর্তন আনা হচ্ছে। পুলিশ বিভাগের পাশাপাশি প্রশাসনেও আনা হচ্ছে সংস্কার। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তনও করা হয়েছে। সামনে আরও পরিবর্তন আনা হবে বলে জানা গেছে। প্রশাসনের শীর্ষ পদ সচিব পদে রদবদল শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া সচিবদের অনেকের চুক্তি বাতিল করা হচ্ছে। নতুন সচিব নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত দেড় দশকে পুলিশ, জনপ্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কিংবা পদায়নের ক্ষেত্রে যোগ্যতার চেয়ে দলীয় বিবেচনা অগ্রাধিকার পেয়েছিল বেশি। যে কারণে সরকার পরিবর্তনের পরই এমন পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। প্রশাসনে কর্মরতরা জানান, ইতোমধ্যেই একটা পরিবর্তনের ঢেউ শুরু হয়েছে। এই পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে রাষ্ট্রের সব স্থানে সংস্কার হবে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়লে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে বেশ পরিবর্তন আনা হয়েছে। যা এখনো চলছে। এবার প্রশাসনের সচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন করা হলো।
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চুক্তি নিয়োগগুলো বাতিল হচ্ছে। এগুলো আগে থেকেই ছিল। তবে চুক্তি নিয়োগে কেউ গেলে সে সফলতা দেখাতে পারে না। কারণ, যে সরকার তাকে চুক্তিতে নিয়োগ দেয় তারা যা চায় সেটাই করতে হয়। সেক্ষেত্রে আইন সংবিধান মানতে চায় না। তাই এসব বাতিল করাটা একটা ভালো সিদ্ধান্ত। এখানে মেধাবী যোগ্যরা ভালো করবে এখন। সাবেক এই সচিব বলেন, এই পরিবর্তনটা খুবই ভালো হবে। প্রশাসন বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগে যে পরিবর্তনগুলো আসছে এতে করে কাজে গতি আসবে। ভবিষ্যতে আমাদের বাংলাদেশ আরও সমৃদ্ধ হবে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে থাকা প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, পুলিশের আইজিপির নিয়োগ বাতিল করা হয়। এরপর গতকাল একযোগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া মোট ১৯ জন সচিব ও সমমর্যাদার মধ্যে ১১ জনের নিয়োগ বাতিল করে পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের এ তালিকায় রয়েছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিম, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব কে এম আবদুস সালাম, সড়ক, পরিবহন বিভাগের সচিব এ বি এম আমিনুল্লাহ নুরী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া, পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিৎ কর্মকার, বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম ওয়াহিদা আক্তার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আলী হোসেন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী সদস্য (সচিব) মো. খাইরুল ইসলাম। একইদিনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলমকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলমের চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে এবং সরকার জনস্বার্থে তাকে সরকারি চাকরি হতে অবসর প্রদান করা প্রয়োজন বলে বিবেচনা করেন। তাই ‘সরকারি চাকরি অবসর আইন, ২০১৮’ এর ৪৫ ধারায় দেওয়া ক্ষমতাবলে তাকে সরকারি চাকরি হতে অবসর দেওয়া হলো। কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও হত্যাকান্ড চালিয়েছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অধীন। এ ছাড়া গত ৭ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের সময় জাহাংগীর আলম নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৩তম ব্যাচের এ কর্মকর্তাকে গত ২১ মে নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব হিসেবে বদলি করা হয়েছিল। এ ছাড়াও এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মো. আখতার হোসেনের অবশিষ্ট চুক্তি বাতিল করে ইউনূস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক লামিয়া মোরশেদকে সিনিয়র সচিবের পদমর্যাদায় এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে তিন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে নতুন সচিব নিয়োগ দিয়েছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন মো. মোকাব্বির হোসেন। তিনি বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়েছেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ পেয়েছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আবদুর রহমান খান।
এদিকে দীর্ঘদিন বঞ্চিত থাকা ১১৭ জন কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ (অতীতের কোনো সময়ে কার্যকর ধরে) উপসচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। মঙ্গলবার এ পদোন্নতি দেওয়া হয়, যা গতকাল সবাই যোগদান করেছে বলে আলাদা আদেশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সরকার পতনের পর পদোন্নতির দাবিতে গত কয়েকদিন ধরেই সোচ্চার ছিলেন এসব কর্মকর্তা। তাদের কারও কারও উপসচিব পদে পদোন্নতি ২০১০ সাল অর্থাৎ ১৪ বছর আগে থেকে কার্যকর ধরা হয়েছে। পাশাপাশি আরও দুই স্তরে পদোন্নতিও দেওয়া হবে।
উপদেষ্টাদের পিএস ও এপিএস নিয়োগ : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সহকারী একান্ত সচিব নিয়োগ দেওয়ার একদিন পর গতকাল কয়েকজন উপদেষ্টার পিএস এবং সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টার পিএস হয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মুফিদুল আলম। স্রেডার পরিচালক (উপসচিব) ড. সৈয়দ মোহাম্মদ আমিনুর রহমানকে শিল্প উপদেষ্টার পিএস নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টার পিএস করা হয়েছে সেতু বিভাগের উপসচিব মো. আবুল হাসানকে এবং এপিএস মো. মোয়াজ্জেম হোসেন নিয়োগ পেয়েছেন। সমাজকল্যাণ উপদেষ্টার পিএস হয়েছেন আইএমইডি উপসচিব মো. মাহমুদ হাসান এবং এপিএস হয়েছেন নাজমুস সাদাত পারভেজ। ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি বিভাগের উপদেষ্টার পিএস করা হয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের উপসচিব র হ ম আলাওল কবিরকে। এ ছাড়াও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টার এপিএস মো. আবিদ চৌধুরী। উপদেষ্টারা যতদিন এ পদ অলংকৃত করবেন বা এই পদে তাদের রাখার ইচ্ছা পোষণ করবেন ততদিন এই নিয়োগ কার্যকর থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। বাকিদেরও যে কোনো সময় প্রজ্ঞাপন হবে বলে জানা গেছে। এই রিপোর্ট লেখার সময় অন্য উপদেষ্টাদের পিএস এপিএস নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। গত কয়েকদিনে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা অতিরিক্ত আইজি মনিরুল ইসলাম ও ঢাকার সাবেক পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান, রংপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান এবং রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আবদুল বাতেনকে। এ ছাড়াও পুলিশের বিভিন্ন স্তরে আনা হয় ব্যাপক রদবদল। বিচার বিভাগেরও রদবদল চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল, তিন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল পদত্যাগ করেছেন। এদের মধ্যে কেউ চাপের মুখে পদ ছেড়েছেন, কেউ পদ ছেড়েছেন স্বেচ্ছায়। এসব জায়গায় নতুনদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মহিউদ্দিন আহমেদ পদত্যাগ করেছেন। তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব বরাবর পদত্যাগপত্র দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে রদবদল করা হয়েছে সম্প্রতি। ডিজিএফআই, এনএসআই, আনসার ও ভিডিপি, এনটিএমসির নতুন মহাপরিচালক নিয়োগ পেয়েছেন ইতোমধ্যেই।
বিভিন্ন অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের শীর্ষ কর্মকর্তারা আতঙ্কে আছেন যে কোনো সময় বদলির অর্ডার হওয়া নিয়ে। বেশির ভাগ দফতর বা সংস্থাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ডিজিসহ ওই প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন বিভাগের কর্মরতদের বদলির দাবিতে সোচ্চার রয়েছেন। অনেকেই এখনো অফিস করতে পারছেন না। দফতর/সংস্থার শীর্ষ পদগুলো পর্যায়ক্রমে দ্রুতই সংস্কার করা হবে বলেও জানা গেছে। খাদ্য অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, মহিলা অধিদপ্তর, তাঁত বোর্ড, বস্ত্র অধিদপ্তরগুলোতে খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য জানা যায়। বিভিন্ন অধিদপ্তরের বঞ্চিত কর্মকর্তারা একজোট হয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। গতকালও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে মহাপরিচালকের অপসারণ চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এ সময় তারা খামারবাড়িকে ঢেলে সাজানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা করেন। সচিবালয়ে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রথমে মন্ত্রণালয় সচিব পর্যায়ে পরিবর্তন এলে তারপর মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যায়ক্রমে দেখা হবে কারা বেশি দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন। তবে অধিদপ্তরগুলোতেও একটা সংস্কার হবে সে আভাসও মিলেছে।
১৩ জনসংযোগ কর্মকর্তা ১৩ মন্ত্রণালয়ে : তথ্য ও জনসংযোগের দায়িত্ব পালনের জন্য ১৩ মন্ত্রণালয়ে ১৩ জন কর্মকর্তাকে সংযুক্ত করা হয়েছে। তথ্য অধিদফতরের জারি করা এক আদেশে বিষয়টি জানানো হয়েছে। এর আগে, ৮ আগস্ট এক অফিস আদেশে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত ৪২ জন জনসংযোগ কর্মকর্তার সংযুক্তি বাতিল করে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।