বিগত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগের তাঁবেদারি করে মন্ত্রী-এমপি, মেয়র আর দলীয় পদ-পদবি পেতে ক্ষমতার ফ্যাক্টরি হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি- বিজিএমইএ। পোশাকশিল্প মালিকদের এই সংগঠনটির নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে- বিজিএমইএ নেতারা সংগঠনকে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে আখের গোছানোর হাতিয়ার বানিয়েছিলেন। নেতারা আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি, মেয়র ও বিভিন্ন রাজনৈতিক পদ-পদবির নেশায় ব্যস্ত ছিলেন। সরকারের সুবিধা নিয়ে অনেকে অঢেল বিত্তের মালিক হয়েছেন। সাধারণ পোশাকশিল্প মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে দর্জিতন্ত্রের কান্ডারি পরিচিত বিজিএমইএ।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি মো. ফারুক হাসান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিগত সাড়ে ১৫ বছরে মন্ত্রী-এমপি, মেয়র বা রাজনৈতিক দলের পদ বাগিয়ে নিতে ক্ষমতার ফ্যাক্টরি হিসেবে বিজিএমইএর একটা বদনাম আছে। সমাজে কিছুটা নেতিবাচক ভাবমূর্তিও তৈরি হয়েছে। তবে মন্ত্রী-এমপি, মেয়র বা রাজনৈতিক দলের পদ পাওয়া নেতারা পোশাকশিল্পের স্বার্থে যথেষ্ট ভূমিকাও রেখেছেন।’ তার মতে- ‘অনেকে আগে থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে বিজিএমইএর নেতা হয়েছেন। অনেকে বিজিএমইএ নেতা হওয়ার সুবাদে রাজনীতিতে সুবিধা নিয়েছেন। আবার আমার মতো অনেককে দলীয় কাজে যুক্ত করার চেষ্টাও হয়েছিল।’
বিজিএমইএ ২০২২ সালে এক তথ্যে বলেছে- বিগত ১২ বছরে ২ হাজার ৭৩৪টি পোশাকশিল্প কারখানা বন্ধ হয়েছে। তবে এসব কারখানা টিকিয়ে রাখতে তেমন কোনো সহায়তা বিজিএমইএ নেতারা করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্র বলছে, বিগত সাড়ে ১৫ বছর পোশাকশিল্প মালিকদের স্বার্থ দেখেননি তাদেরই সংগঠন বিজিএমইএ নেতারা। তারা সংগঠনকে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ ও আখের গোছানোর হাতিয়ার বানিয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে কোটারি গ্রুপের কাছে জিম্মি করে রেখেছিলেন বিজিএমইএ-কে। সংগঠনটিতে নেই কোনো সুশাসন।
বিগত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী রাজনীতিতে সুসময়ই গেছে পোশাকশিল্প মালিকদের। এক সময়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অথবা সুসম্পর্ক রেখে চলা অনেকেই বিগত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের টিকিটে মন্ত্রী-এমপি, মেয়র হয়েছেন। দলীয় রাজনীতি না করেও কেউ কেউ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও মেয়রের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। শুধু এমপি-মন্ত্রীই নন, দলীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েছিলেন পোশাকশিল্প মালিকরা। আরও অনেকেই ছিলেন পাইপ লাইনে। যারা আওয়ামী লীগে সুবিধা করতে পারেননি, তারা গোপনে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি ফয়সাল সামাদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কোনো ব্যবসায়িক সংগঠনকে রাজনৈতিক চিন্তাধারা বা উদ্দেশ্যে ব্যবহার সমর্থন যোগ্য না। রাজনীতি আর ব্যবসা একসঙ্গে চলতে পারে না। বিজিএমইএ-তে রাজনীতির জন্য ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা হয়নি। গত এক দশকে বিজিএমইএ ব্যক্তিস্বার্থ পূরণে ব্যবহৃত হয়েছে। বিজিএমইএ-কে ব্যবহার করে অনেকে রাজনৈতিক নেতা হয়েছেন। অনেকে মন্ত্রী, এমপি, মেয়র হয়েছেন। এমনকি বিজিএমইএ নেতা হওয়ার সুবাদে অনেকে রাজনৈতিক পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে সমাজের কাছে বিজিএমইএর নেতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিফলিত হয়েছে।
বিগত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ওই বছরের মার্চে বিজিএমইএ সভাপতি হয়েছিলেন এক সময়ের বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত তারকা ফুটবলার ও এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী। পরবর্তীতে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে দুবার এমপি হয়েছেন। আর পিতার কোটায় দুই দফায় বিজিএমইএ পরিচালক হয়েছেন আবদুস সালাম মুর্শেদীর কন্যা শেহেরিন সালাম ঔশি।
এরপর ২০১১ সালের মার্চে বিজিএমইএ সভাপতি হন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। বিজিএমইএ সভাপতি পদ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাব ও আশীর্বাদে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআই সভাপতি হন। এরপর আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি বনে যান মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন।
২০১৩ সালের মার্চে বিজিএমইএ সভাপতি হন মো. আতিকুল ইসলাম। তার ঘনিষ্ঠজনরা বলতেন- তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাবে বাড়তি ছয় মাস বিজিএমইএ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন আতিক। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে দুই দফায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র হন মো. আতিকুল ইসলাম। মেয়র হিসেবে চরম ব্যর্থ ও বিতর্কিত হয়েছেন তিনি।
২০১৫ সালে বিজিএমইএ সভাপতি হয়েছেন মো. সিদ্দিকুর রহমান। দুই বছরের কমিটির মেয়াদ বাড়িয়ে সাড়ে তিন বছর নিজের দখলে রাখতে বিশেষ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে হতে চেয়েছিলেন এমপি-মন্ত্রী। তা হতে না পারলেও, হয়েছেন আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক। হয়েছিলেন এফবিসিসিআই সহসভাপতি।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আস্থাভাজন হিসেবে ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রথমবারের মতো নারী হিসেবে বিজিএমইএ সভাপতি হন মোহাম্মদী গ্রুপের কর্ণধার ড. রুবানা হক। এক্ষেত্রে তার স্বামী ও ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র প্রয়াত আনিসুল হকের পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তারকা ব্যবসায়ী আনিসুল হকও বিজিএমইএ সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সেনাসমর্থিত এক-এগারো সরকারের আমলে এফবিসিসিআই সভাপতি হন। এরপর হয়েছিলেন দক্ষিণ এশীয় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন সার্ক চেম্বারের সভাপতি। রাজনীতি না করেও হঠাৎ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ঢাকা উত্তরের জনপ্রিয় মেয়র হয়েছিলেন আনিসুল হক। পিতা-মাতার পরিচয়ে এই দম্পতির পুত্র নাভিদুল হকও বিজিএমইএ পরিচালক হয়েছিলেন।
সমঝোতার মাধ্যমে কমিটি গঠনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে ২০২১ সালের এপ্রিলে সরাসরি নির্বাচনে বিজিএমইএ সভাপতি হন ফারুক হাসান। তিনি কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতায় ঝোঁকেননি। তবে তাকে রাজনৈতিক কাজে যুক্ত হওয়ার চাপ ছিল বলে জানিয়েছেন।
এ বছর এপ্রিলে বিজিএমইএ সভাপতি হন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি। তিনি দীর্ঘ দিন বিজিএমইএ সহসভাপতি ছিলেন। তবে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক-পট পরিবর্তনের পর বিজিএমইএ নেতাদের একাংশের তোপের মুখে সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এস এম মান্নান কচি। তিনি বর্তমান কমিটিতে পরিচালক হিসেবে বহাল রয়েছেন।
এরপর গত ২৪ আগস্ট জরুরি বোর্ড সভায় যে পুনর্গঠিত কমিটি হয়, তাতে বিজিএমইএ সভাপতি হন ডিজাইন টেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার রফিকুল ইসলাম। তার কাছে গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রশ্ন ছিল- বিগত সাড়ে ১৫ বছরে বিজিএমইএ পরিচয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপি, মেয়র ও দলীয় পদে বসা নেতাদের কীভাবে মূল্যায়ন করছেন? জবাবে বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন- ‘ট্রেড পলিটিক্স বা বাণিজ্য সংগঠনের নেতৃত্ব প্রদান আর জাতীয় রাজনীতি দুটোই আলাদা থাকা উচিত। ব্যবসা আর রাজনীতি একসঙ্গে চলতে পারে না। এই অপসংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। বিজিএমইএ ক্ষমতার একটা ফ্যাক্টরি, মানুষ যে ধারণ পোষণ করছে, সেটাও পরিবর্তন করতে হবে।’
বিজিএমইএর সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মাহামুদ হাসান খান বাবু গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অনেকের কাছে বিজিএমইএ সভাপতি বা নেতা হওয়াটা ছিল ফ্যাশন। বিজিএমইএ পদ-পদবি ব্যবহার করেছেন, মন্ত্রী-এমপি ও মেয়র হয়েছেন। আবার অনেক নেতা আছেন, যারা এসব পদ-পদবির পিছু ছোটেননি। অনেক নেতা মন্ত্রী-এমপি আর মেয়র হিসেবে পোশাকশিল্পের স্বার্থে ভূমিকা রাখলেও, অনেকে রাখেননি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মন্ত্রী-এমপি, মেয়র আর দলীয় পদে বসা নেতারা ব্যক্তি স্বার্থে বিজিএমইএ-কে ব্যবহার করেছেন।’
সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৮ জন পোশাকশিল্প মালিক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাদের সংবর্ধনা দেয় এ খাতের নির্বাচন কেন্দ্রিক জোট সম্মিলিত পরিষদ। নির্বাচিত ১৮ সংসদ সদস্য (বর্তমানে সাবেক) হলেন- বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, সেপাল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিপু মুনশি, উইসডম অ্যাটায়ার্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান এ কে এম সেলিম ওসমান, এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী, ফেবিয়ান গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মো. তাজুল ইসলাম, হামিদ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নসরুল হামিদ, রেনেসাঁ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা শাহরিয়ার আলম, বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান মোর্শেদ আলম, হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ, ওয়েল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, শাশা ডেনিমস লিমিটেডের চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, স্প্যারো গ্রুপের চেয়ারম্যান চয়ন ইসলাম, মন্ডল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মমিন মন্ডল, তুসুকা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়জুর রহমান (বাদল), নিপা গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. খসরু চৌধুরী, এক্সিস নিটওয়্যার লিমিটেডের দেওয়ান জাহিদ আহমেদ, স্মার্ট গ্রুপের মুজিবুর রহমান এবং এ অ্যান্ড এ ফ্যাশন স্যুয়েটারস লিমিটেডের মো. আবদুল ওয়াদুদ।