জুলাই-আগস্টে ‘গণহত্যার’ অভিযোগে করা বিভিন্ন মামলায় এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া ২০ জনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আনিসুল হক, দীপু মনিসহ ১০ মন্ত্রী, সালমান এফ রহমানসহ দুই উপদেষ্টা, একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, একজন সচিব, পাঁচ পুলিশ ও এক সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন। সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব, বিচারপতিসহ ১৪ জনকে আগামী ১৮ নভেম্বর এবং ছয়জন সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাকে ২০ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিবসহ ১৭ পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করেছে ট্রাইব্যুনাল।
পৃথক তিন আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন। অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এর আগে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আবেদনগুলো ট্রাইব্যুনালের সামনে উপস্থাপন করেন। এ সময় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম, বি এম সুলতান মাহমুদ, মো. সাইমুম রেজা তালুকদার ও আবদুল্লাহ আল নোমান সঙ্গে ছিলেন।
১৮ নভেম্বর যাদের হাজিরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তারা হলেন- সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক মন্ত্রী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক মন্ত্রী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জ্বালানি, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম। তারা সবাই বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন।
২০ নভেম্বর যাদের হাজিরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তারা হলেন- সাবেক পুলিশপ্রধান (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, পুলিশের সাবেক ঢাকা জেলা এসপি আবদুল্লাহ হিল কাফী, সাভারের সাবেক ওসি আবুল হাসান এবং পুলিশ কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম ও আরাফাত হোসেন। অন্য আবেদনে ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিবসহ ১৭ পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এই ১৭ জনের মধ্যে র্যাবের সাবেক ডিজি, এসবির সাবেক প্রধান, ডিবির সাবেক প্রধানের নামও রয়েছে। তবে তদন্ত ও গোপনীয়তার স্বার্থে এসব নাম প্রকাশ করেনি প্রসিকিউশন টিম। আদেশের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা ট্রাইব্যুনালে তিনটি অ্যাপ্লিকেশন দিয়েছি। একটা ছিল আগে যাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছিল এবং যারা ওয়ারেন্ট ইস্যুর আগে গ্রেপ্তার হয়েছিল তাদের গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য দুটি আবেদন করা হয়েছে। সেই অ্যাপ্লিকেশনে মোট ২০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে এবং তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
তিনি বলেন, যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা, সাবেক ১০ মন্ত্রী, এক সেনা কর্মকর্তা ও সাবেক এক সচিবকে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আগামী ১৮ নভেম্বর তাদের উপস্থিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, দ্বিতীয় পিটিশনে আমরা ছয়জনের বিরুদ্ধে শোন অ্যারেস্ট দেখানোর জন্য আবেদন করেছিলাম। তারা বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে যেহেতু আমরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়েছি, তাই তাদেরও এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়েছিল। তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আগামী ২০ নভেম্বর উপস্থিত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
মো. তাজুল ইসলাম বলেন, তৃতীয় আবেদনে ১৭ জনের বিরুদ্ধে নতুন করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছিলাম। আদালত সে আবেদনও মঞ্জুর করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। নিরাপত্তাজনিত কারণে সেই ১৭ জনের সবার নাম আমরা বলতে পারছি না। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। আগামী ২০ নভেম্বর উপস্থিত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, জুলাইয়ের ঘটনায় যেসব পুলিশ অফিসার সরাসরি যুক্ত ছিল এবং যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাদেরকে গ্রেপ্তার করা বা দেখানোর আবেদন করছি। যারা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল না তাদের ভয়ভীতির কারণ নেই। আমরা নির্দোষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চাইব না। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের নাম ধারাবাহিকভাবে সামনে নিয়ে আসব। অপরাধ করেছে এমন কোনো ব্যক্তিকে ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, গণহত্যার সব মামলার বাদী হবেন চিফ প্রসিকিউটর। প্রথম মিস কেসের মধ্যে শেখ হাসিনা এবং দ্বিতীয় মিস কেসে ওবায়দুল কাদেরসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা এবং তৃতীয়ত মিস কেসে পুলিশ সদস্যদের নেওয়া হয়েছে। প্রথম যখন মামলা করা হয়েছে আমরা অপরাধীদের নাম প্রকাশ করিনি, যাতে তারা কেউ পালিয়ে যেতে না পারে। এর আগে গত ১৭ অক্টোবর জুলাই-আগস্টে সংগঠিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের পৃথক মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই ৪৬ জনের মধ্যে রয়েছে- শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই সাবেক এমপি শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তার দুই ভাতিজা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস, যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও রয়েছেন।