কাটছে না চিকিৎসায় আস্থার সংকট। দেশের সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা প্রকট। বেসরকারিতে রয়েছে আস্থার সংকট, প্রতারণার ফাঁদ। উচ্চবিত্তের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতাকে এসব কারণ আরও উসকে দিচ্ছে। ভালো সেবার আশায় মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষও ছুটছে বিদেশে। বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে মেডিকেল ভিসার জন্য ভিড় করছে মানুষ। জানা যায়, উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রতি বছর দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। একই চিকিৎসা বাংলাদেশে করতে যে ব্যয় হয়ে থাকে, তা করতে ভারতে খরচ প্রায় দ্বিগুণ। থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে ৩ থেকে ১০ গুণ বেশি। তবে হাসপাতালের বিল, কেবিন খরচসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচাপাতি হিসাব করলে খরচ প্রায় কাছাকাছি হয়ে আসে। যার কারণে স্থানীয় হাসপাতালগুলোর প্রতি অনীহা বেড়েই চলেছে দিন দিন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আস্থার সংকট আছে। এখানে চিকিৎসা খরচ বেশি, চিকিৎসা নিতে গিয়ে দুর্ভোগের শিকার হতে হয় রোগীদের। চিকিৎসা সবই ঢাকাকেন্দ্রিক। এসব কারণ রোগীদের বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রোগীদের বিদেশ যাওয়া ঠেকাতে সরকারি হাসপাতালে কার্যকর সেবা নিশ্চিত করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালে সেবার দাম ও মান নির্ধারণ করে সেটা টানিয়ে রাখতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ক্যাটাগরি অনুযায়ী দাম ঠিক করে দিতে হবে। রোগী তার সামর্থ্য অনুযায়ী সেবা নিতে পারবেন। ডায়াগনস্টিকেও দাম নির্ধারণ করে মান নিশ্চিত করতে হবে। প্রেসক্রিপশন অডিট চালু করতে হবে। সরকারি হাসপাতালে ডায়াগনস্টিক সেবা জোরদার করতে হবে। চিকিৎসায় রেফারেল পদ্ধতি চালু করতে হবে। হাসপাতাল থেকে দালাল ও বিদেশি এজেন্টদের উচ্ছেদ করতে হবে।’ কুষ্টিয়ার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম (৪০) বেশ কিছুদিন ধরে বুকে ব্যথা, হঠাৎ ঘেমে যাওয়াসহ শরীরে বিভিন্ন রকম অস্বস্তি অনুভব করছিলেন। তিনি বলেন, ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দেখালে তারা বলেন আমার ভাল্বে সমস্যা। তাই ভাল্ব প্রতিস্থাপন করতে হবে। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালে খরচ এবং চিকিৎসার মান পছন্দ না হওয়ায় সরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিই। সরকারি হাসপাতালে খরচ কম এবং মান ভালো হলেও দীর্ঘ সিরিয়ালের কারণে চার মাসের আগে আমার চিকিৎসা সম্ভব নয় বলে জানান। তিনি বলেন, আমার এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালের ব্যাপারে জানতে পারি। তাদের চিকিৎসার খরচ আমার সামর্থ্যরে মধ্যে হওয়ায় ভিসা করিয়ে থাইল্যান্ড থেকে চিকিৎসা করিয়েছি। আমি এখন সুস্থ আছি, শারীরিক কোনো সমস্যা নেই। ওই হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহার খুব আন্তরিক। অথচ দেশের হাসপাতালে দায়িত্বরত লোকজনের ব্যবহার দেখলেই ভয় লাগে।’ রোগীদের বিদেশমুখী স্রোত শুরু হলেও দেশের সেবার মান উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নেই। রোগে আক্রান্ত হলে উচ্চবিত্তরা যান সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। আর মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত সাধ্যের মধ্যে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করান। জয়পুরহাটের বাসিন্দা রীতা রানী (৩০) পেটের ব্যথা, হজমের সমস্যা নিয়ে নওগাঁর একটি বেসরকারি হাসপাতালে গ্যাসট্রোএন্ট্রোলজির ডাক্তার দেখান। তিনি বলেন, ডাক্তার জানান আমার লিভারে ইনফেকশন হয়েছে। সেজন্য দুই মাস সময় দিয়ে অনেক ওষুধ এবং ইনজেকশন দেন। কিন্তু ওষুধ খেয়ে, ইনজেকশন দিয়ে আমি আরও অসুস্থ হয়ে যাই। পরে অন্য ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানতে পারি আমার ইনফেকশনের কোনো সমস্যাই ছিল না। কিন্তু ভুল চিকিৎসার কারণে আমার লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। সেখান থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ঢাকাতে ডাক্তার দেখালেও তারা কোনো আশার আলো দেখাতে পারেননি। রীতা রানী আরও বলেন, কোনো উপায় না পেয়ে জীবন বাঁচাতে আমার স্বামী ভারতের হায়দরাবাদের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাচ্ছেন। খরচ সামলাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। কিন্তু শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় কষ্ট হলেও আমরা চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি। দেশের চিকিৎসা উন্নত হলে আমাদের এত সমস্যায় পড়তে হতো না।’ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, দেশের মানুষ নানা কারণে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায়। এর মধ্যে মানসিক আস্থার সংকট অন্যতম। আবার ১৬ কোটি মানুষের জন্য যত ভালোমানের হাসপাতাল থাকার কথা, সেটা সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে নেই। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অনেকে প্রতিবেশী দেশে যায়। তিনি আরও বলেন, ‘বিদেশে মানুষ বেড়াতেও যায়। আবার অনেকে চিকিৎসাও করিয়ে আসে। একসঙ্গে দুই কাজ হয়। আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রযুক্তির উন্নয়ন তেমন ঘটেনি। কাজেই রোগীরা বিদেশমুখী হয়। কারণ, শরীরটা তার নিজের। রোগী যদি মনে করে এখানকার চিকিৎসা ভালো নয়, তাহলে সে বিদেশ যাবেই। আসলে এটা রোগীর চিন্তাভাবনার ওপর নির্ভর করে।’