বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান খালাস পেয়েছেন। অন্য সব আসামিকেও খালাস দিয়েছেন হাই কোর্ট। এ-সংক্রান্ত দুটি ডেথ রেফারেন্স খারিজ ও আসামিদের আপিল এবং জেল আপিল মঞ্জুর করে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ গতকাল এ রায় দেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে বিচারিক আদালত যে প্রক্রিয়ায় বিচার করেছে, তা ছিল অবৈধ।
রায় ঘোষণার সময় আদালতে আসামিপক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. জসিম সরকার।
বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, বিএনপির আইন সম্পাদক অ্যাডভোকেট কায়সার কামাল রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের স্ত্রী তাহমিনা জামান শ্রাবণী ও এক ছেলে আদালতে উপস্থিত ছিলেন। গত ২১ নভেম্বর এ মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ড অনুমোদন) ও আপিল শুনানি শেষ হয়। সেদিন বিষয়টি রায়ের জন্য সিএভি (মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমান) রাখেন আদালত। গত ৩১ অক্টোবর হাই কোর্টে এই মামলার শুনানি শুরু হয়। গতকাল রায়ের জন্য বিষয়টি কার্যতালিকায় আসে।
গতকাল সকাল ১১টায় জনাকীর্ণ এজলাসে রায় ঘোষণা শুরু করেন আদালত। শুরুতেই আদালত বলেন, আমরা পুরো রায়টিই প্রস্তুত করেছি। তবে এখন সংক্ষিপ্ত অংশ তুলে ধরব। এর পর রায় পড়া শুরু করেন আদালত। বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে রায় পড়া শেষ হয়। রায়ের বিষয়ে আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী এস এম শাহজাহান সাংবাদিকদের বলেন, ২০০৮ সাল থেকে আমি এই মামলার পেছনে আছি। প্রথম যখন এই মামলা শুরু হয়, তখন থেকে আজ পর্যন্ত গত ১৬ বছর এই মামলায় আসামিপক্ষে আমি যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছি। হাই কোর্টের যে বেঞ্চে আজ মামলাটির নিষ্পত্তি হলো, সেই কোর্টকে আমরা আন্তরিকভাবে সাধুবাদ জানাই। আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি। এর দুটো দিক, সাক্ষ্য এবং আইন। কোনো দিক থেকেই এই মামলা প্রমাণিত হয়নি।
তিনি বলেন, আইনের ছাত্র হিসেবে আমি একটা কথা বলতে পারি, অপরাধের গুরুত্ব বা নৃশংসতা যতটাই হোক না কেন, আসামিকে সাজা দিতে হলে তার সম্পৃক্ততা দেখতে হবে। কাজেই ২১ আগস্ট যে ঘটনা ঘটেছে একে আমরা নিন্দা জানাই। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এই মামলার তদন্ত হয়ে যে অভিযোগপত্র এল, যে বিচার ১৬ বছর ধরে চলল তার নিষ্পত্তি হলো আজ। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যারা আপিল করেননি তাদেরসহ হাই কোর্ট সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন। ফলে তারেক রহমান, কায়কোবাদসহ যারা আপিল করেননি তাদের খালাস দেওয়া হয়েছে। আমরা আদালতের কাছে কৃতজ্ঞ। মফস্বল আদালতে একটা কথা প্রচলিত আছে, নথিসুদ্ধ খালাস। এই মামলাটিও নথিসুদ্ধ খালাস হয়েছে। আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, যে বিচার করা হয়েছিল, সেটি ছিল অবৈধ। কারণ আইনের ভিত্তিতে সেই বিচার হয়নি। একই সঙ্গে আদালত বলেছেন, কোনো সাক্ষীর সঙ্গে কোনো সাক্ষীর কোনো কোলাবরেশন নেই। শোনা সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে সাজা দেওয়া হয়েছিল। সেজন্য সবার আপিল নিয়ে ডেথ রেফারেন্স রিজেক্ট করে সবাইকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। তারেক রহমান ও লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সবাইকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত। তিনি বলেন, একই সঙ্গে মুফতি হান্নান দুটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আমরা বলেছিলাম, ৪০০ বছরের ইতিহাসে ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বিতীয় জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে কাউকে সাজা দেওয়ার নজির নেই।
বিচার প্রক্রিয়া ছিল অবৈধ : রায়ের পর্যবেক্ষণে হাই কোর্ট বলেন, কোনো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে অন্য আসামিকে সাজা দেওয়া যায় না। একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে দন্ডবিধির ১২০(খ) (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের শাস্তি) প্রমাণ করা যায় না। মুফতি হান্নানের প্রথম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে প্রথম অভিযোগপত্র আনা হয়েছিল। ফলে প্রথম অভিযোগপত্র যাদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধেও আদালত ওই স্বীকারোক্তি ছাড়া আর কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাননি। দ্বিতীয় অভিযোগপত্রে তারেক রহমানসহ অন্যান্য যাদের আসামি করা হলো, তাদের বেলায়ও দেখা গেছে, মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ছাড়া আর কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। দুটি জবানবন্দিই মুফতি হান্নান স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করে গেছেন। ফলে প্রত্যাহার করা স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে কাউকে সাজা দেওয়া যায় না। এমনকি যে আসামি স্বীকারোক্তি করেছেন, উনি যদি বেঁচে থাকতেন, তার পরও এটা প্রযোজ্য হতো না।
আদালত বলেছেন, দ্বিতীয় অভিযোগপত্র অতিমাত্রায় বেআইনি। কারণ, দ্বিতীয় অভিযোগপত্র নিয়ে আইনের যে বিধান আছে, অফিসার ইন চার্জ নতুন কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পেলে সম্পূরক অভিযোগপত্র দিতে পারেন। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় অভিযোগপত্রটি আনা হয়েছে পাবলিক প্রসিকিউটরের আবেদনে। এই আবেদনটি মঞ্জুর করে আদালত যখন মামলাটি পুনঃতদন্তের জন্য পাঠালেন, পুনঃতদন্তের প্রতিবেদন আসার পর সেই অভিযোগপত্র কোনো ম্যাজিস্ট্রেট গ্রহণ করেননি। সরাসরি এটি মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। মহানগর দায়রা আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৩ ধারা অনুসারে আমলে নিয়েছেন। কিন্তু ১৯৩ (১) অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগ আমলে না নিলে মহানগর দায়রা আদালতে দাখিল হতে পারে না। রায়ে হাই কোর্ট আরও বলেন, দ্বিতীয় অভিযোগপত্রটি আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে ১৯৩(১) ধারা অনুসরণ করা হয়নি। ফলে দ্বিতীয় অফিযোগপত্রটি আমলে নেওয়া বেআইনি এবং আইনের দৃষ্টিতে তার কোনো কার্যকারিতা নেই। তা ছাড়া প্রথম অভিযোগপত্রটিও গ্রহণযোগ্য না। কারণ, ওই অভিযোগপত্রটিও মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করেই করা হয়েছে; যা তিনি পরে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেট বাদ দিয়ে ২২৫ জন সাক্ষীর কেউই বলেননি আমি গ্রেনেড ছুড়েছি বা ছুড়তে দেখেছি। ফলে, প্রকৃত খুনি কে সেটি নেই। এখানে দন্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুসারে মৃত্যুদন্ড দেওয়া যায় না।
ঘটনা ও বিচার প্রক্রিয়া : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। অল্পের জন্য ওই হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও জাতীয় সংসদে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তবে হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক, সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলের ৩ শতাধিক নেতা-কর্মী। ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা হয়। তদন্ত শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ জুন দেওয়া অভিযোগপত্রে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ও হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পর অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। দুই বছর তদন্তের পর ২০১১ সালের ৩ জুলাই ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এর ফলে এ মামলায় মোট আসামির সংখ্যা হয় ৫২।
মোট ৫২ আসামির মধ্যে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও মুফতি হান্নান এবং তার সহযোগী শাহেদুল ইসলাম বিপুলের মৃত্যুদন্ড অন্য মামলায় কার্যকর হয়। তিনজনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ায় এ মামলার আসামি দাঁড়ায় ৪৯ জনে। এ ঘটনার মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর দেওয়া বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা ছিলেন- লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজির সাবেক আমির ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির আহ্বায়ক মাওলানা শেখ আবদুস সালাম (কারাগারে মারা যান), কাশ্মীরি জঙ্গি আবদুল মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. উজ্জ্বল, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম (কারাগারে মারা যান) ও হানিফ পরিবহনের মালিক বিএনপি নেতা মোহাম্মদ হানিফ।
পরিকল্পনা ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যার অভিযোগে দন্ডবিধির ৩০২/১২০খ/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে তাদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে ১ লাখ টাকা করে জরিমানা করেন আদালত।
যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্তরা ছিলেন- তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ (কারাগারে মারা যান), মাওলানা সাব্বির আহমেদ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম মাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, মো. খলিল ওরফে খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল ওরফে ইকবাল হোসেন, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই ও রাতুল আহমেদ ওরফে রাতুল বাবু।
তাদের দন্ডবিধির ৩০২/১২০খ/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়।
এ ছাড়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হক, বিএনপি চেয়ারপারসন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগনে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, ডিজিএফআইয়ের মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন, ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, আরেক সাবেক উপকমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির সাবেক বিশেষ সুপার মো. রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে দুই বছর করে কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়। আরেকটি ধারায় খোদা বক্স চৌধুরী, রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদন্ড দেন আদালত। এই ৪৯ জনের মধ্যে রায় দেওয়ার সময় ৩১ জন কারাগারে ছিলেন।