সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার এই তিন মূলনীতি বাস্তবায়নের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, এসব মূলনীতি বাস্তবায়ন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা পূরণের জন্য স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমাদের লড়াই করতে হচ্ছে। স্বাধীনতার স্বাদ আমরা এখনো পুরোপুরি পাইনি। আমার বয়স এখন ৭৩ বছর। যে আদর্শ ও প্রত্যাশা নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি তার বাস্তবায়ন অর্থাৎ একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যদি মৃত্যুর আগে দেখে যেতে পারি তবে আত্মার শান্তি মেলবে। মুক্তিযুদ্ধে যখন যাই আমার বয়স তখন ১৯ বছর। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাতেই ছিলাম। পরদিন বহুকষ্টে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনাতে চলে যাই। সারাদিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় থাকার পর ২৬ মার্চ রাতে জিয়াউর রহমানের ভাষণে শুনলাম, তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন। পরবর্তিতে জিয়াউর রহমান তাঁর ভাষণে পরিবর্তন এনে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারপর এক মাস এলাকাতেই থাকলাম। তখন হিন্দু সম্প্রদায়ের যারা শরণার্থী হিসেবে ভারতে যাচ্ছিলেন, তাদের ওপর আক্রমণ এবং ছিনতাই ঠেকাতে আমরা যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক ছিলাম তাদের একত্রিত করে নিরাপত্তা টিম গঠন করি। মে মাসে চলে যাই ভারতে। এরপর ট্রেনিং শেষ করে যোগ দিই মুক্তিযুদ্ধে।
আমাদের প্রত্যাশা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন হবে। কিন্তু স্বাধীনতার পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও বাকস্বাধীনতা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। যুদ্ধের পেছনে যে তিন মূলনীতি ছিল স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমরা এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারিনি। ’৭২ থেকে ’৭৫ এই সময়কালে শেখ মুজিব বাকস্বাধীনতা হরণ, বাকশাল কায়েম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদের ৩০ হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা এরকম আরও অনেক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পথে না গিয়ে দেশে স্বৈরশাসন কায়েম করেন। ’৭৩ এর সংসদ নির্বাচনে জাল ভোটের সাহায্যে বিজয়ী হয়ে শেখ মুজিব জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেন। শেখ মুজিব গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন নাই। এসব কারণে ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কিছু দেশপ্রেমিক অফিসার ও জোয়ানের হাতে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। এরপর ঘটনার পালাক্রমে জিয়াউর রহমান দেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দেশে নির্বাচন আয়োজন করেন। সেটিই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। সেই নির্বাচনে আমি নিজেও অংশ নিয়েছিলাম এবং সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। জিয়াউর রহমান দেশের মানুষকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এরশাদের আমলে আবারও দেশ অগণতান্ত্রিক পথে চলে যায়। ১৯৮৯-৯০ সালের ছাত্র আন্দোলন ও গণ অভ্যুত্থানের পর এরশাদের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। এই সরকারের আমলে দেশে একটি অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলাম এবং জাতীয় পার্টি সবাই নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইলেন। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় থাকার পরও ওই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা দিয়ে দেয় এবং বিএনপি বিজয় লাভ করেও সরকার গঠন করতে পারে নাই। শেখ হাসিনা সরকারে আসে।
এরপর ২০০১ সালে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। তখনো মানুষের বাকস্বাধীনতা, মানবিক মর্যাদা এবং সাম্য প্রবর্তনের জন্য যে সমস্ত কর্মকান্ডগুলো বিএনপি আমলে হয়েছে সেই সময়ও মানুষ অন্তত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বাদ পেয়েছে।
২০০৮ থেকে দেশ আবারও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংসের দিকে চলে যেতে থাকে। ওই সময়েও আমি নির্বাচনে অংশ নিই। কিন্তু ওটাকেও সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যায় না। কারণ ওই সময় সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী এবং অন্যান্য যে বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তাসহ সবাই চেয়েছে যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসুক। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। এরপর শেখ হাসিনা যখন ২০১২ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিল। আমরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলাম। ২০১৪ সালে তো দেশে নির্বাচনই হয়নি। কারণ এই নির্বাচনে কেউ অংশগ্রহণই করেনি। ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা করে নির্বাচনে অংশ নিলাম। কিন্তু সেই নির্বাচনে দিনের ভোট হয়ে গেল রাতে। এরপর ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এর প্রার্থী এবং বিপরীতে আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থীর নির্বাচন করা হলো। ভোট হলো একতরফা। গণতন্ত্রের কোনো বালাই শেখ হাসিনার ১৫ বছরে ছিল না।