পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিত করবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। প্রয়োজনে বাড়াতে হবে কমিশনের পরিধি। একই সঙ্গে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার কমানো, মব কন্ট্রোলে পাঁচ ধাপের পদ্ধতি প্রয়োগ নিয়ে মোট ১৫ সুপারিশ করা হয়েছে পুলিশ সংস্কার কমিশনের মূল প্রতিবেদনে। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে কর্মঘণ্টা, মেডিকেল কোর গঠন এবং প্রয়োজন হলে পদ সৃষ্টি করে নারী সদস্যের সংখ্যা ২৯ হাজার ২৪৮ জন করার বিষয়টি। গতকাল সকালে ১৩০ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদন এবং ১৫০ পৃষ্ঠার এনেক্সার (বিভিন্ন সংগঠনের প্রস্তাব) আকারে জমা দেওয়া হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কার্যালয়ে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফররাজ হোসেনের নেতৃত্বে ৯ জন সদস্য গতকাল কাক্সিক্ষত সেই প্রতিবেদন জমা দেন। জানা গেছে, ‘কেমন পুলিশ চাই’ শীর্ষক পুলিশ সংস্কার কমিশনের অনলাইন জনমত জরিপে মোট ২৪ হাজার ৪৪২ জন মতামত দিয়েছেন। জরিপে ৮৯ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অবসান চেয়েছেন। একই সঙ্গে পুলিশ বাহিনীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। জরিপে গুম, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ডে চরম মানবিকতার লঙ্ঘন বিবেচনায় অপরাধী পুলিশকে জবাবদিহি ও শাস্তির আওতায় আনার পক্ষে মত দেন ৭৪ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা। ভুয়া বা গায়েবি মামলার অপসংস্কৃতির সংস্কার চান শতকরা ৯৫ জন। এদিকে মূল প্রতিবেদনে পুলিশ সদর দপ্তরের প্রস্তাবনার অনেক কিছুই উঠে আসেনি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক শীর্ষ কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব কর্মকর্তা বলেছেন, আমাদের প্রত্যাশার অনেক কিছুই নেই। দুই স্তরের নিয়োগটা খুব জরুরি ছিল। তা এড়িয়ে গেছেন সংস্কার কমিশন। পুলিশ কমিশনের বিষয়েও আরও ডিটেইলস রাখা উচিত ছিল। গত রাতে পুলিশ সংস্কার প্রতিবেদন সম্পর্কে কমিশনের সদস্য সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইকবাল বলেছেন, আমরা প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। কমিশন গঠন করবেন কি করবেন না তা রাজনৈতিক সরকার দেখবেন। জবাবদিহিতা এবং মানবাধিকার নিশ্চিতের ওপর আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। এর বাইরে আর কিছু বলতে চাচ্ছি না।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আদালতের আদেশ ব্যতীত কোনোক্রমেই এফআইআরের বহির্ভূত আসামিকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। আটক ব্যক্তি বা রিমান্ডে নেওয়া আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিটি থানায় স্বচ্ছ কাচের ঘোরাটোপ দেওয়া একটি আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ অবশ্যই থাকবে। পুলিশের তত্ত্বাবধানে থানা হাজত ও কোর্ট হাজতের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং বন্দিদের কোর্ট থেকে আনা-নেওয়ার সময় ব্যবহারকারী যানবাহনগুলোতে মানবিক সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচ্ছন্নতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। নারী আসামিকে যথেষ্ট শালীনতার সঙ্গে নারী পুলিশের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। মূল প্রতিবেদনের ৩৭, ৪১ এবং ৬৩ থেকে ৬৫ পৃষ্ঠায় এসব বিষয় সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তের জন্য সরাসরি সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওপর ন্যস্ত করার জন্য জোর সুপারিশ করা হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা বা তাদের প্ররোচনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে, সংশ্লিষ্ট সংস্থা প্রধান নিজেই যাতে তদন্তের নির্দেশ প্রদান করতে পারবেন। এজন্য সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রধান কার্যালয়েও মানবাধিকার সেল রাখতে হবে। প্রভাবমুক্ত জবাবদিহিমুক্ত পুলিশ বাহিনীর জন্য ‘পুলিশ কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশন আইনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হবে নাকি সাংবিধানিক কাঠামোভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান হবে তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ পুলিশ কমিশনের গঠন, কার্যপরিধি, সাংবিধানিক বা আইনি বাধ্যবাধকতা, আইনে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন বিষয়াদি বিচার-বিশ্লেষণ ও যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন হবে। পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে চাকরিপ্রার্থীর রাজনৈতিক মতাদর্শ যাচাইবাছাইয়ের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। এজন্য সব পুলিশ ভেরিফিকেশন সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে। অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন হলে সর্বোচ্চ ১৫ (পনেরো) দিন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা যেতে পারে। নারী পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বর্তমানে অর্গানোগ্রামে পদ সৃষ্টি করতে হবে। বর্তমানে ১৬৮০১ থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ২৯ হাজার ২৪৮ করার সুপারিশ করা হয়েছে। পুলিশের পদোন্নতি ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ বড় নির্ণায়ক হিসেবে বিবেচিত হবে। এজন্য যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেবে কর্তৃপক্ষ। পুলিশের প্রশিক্ষণ একাডেমি এবং কেন্দ্রগুলোতে ‘ডাম্পিং’ হিসেবে পদায়নের ধারণা পরিবর্তন করাতে হবে। মেধাবী এবং দক্ষ কর্মকর্তাদের সেখানে পদায়ন করতে হবে। পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত ডোপ টেস্ট এবং সাইকোলজিক্যাল টেস্টের আওতায় আনতে হবে। অতিরিক্ত কাজের চাপ কমানোর জন্য কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট করতে হবে। ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করলে তাদের প্রণোদনা দিতে হবে। জানা গেছে, পুলিশের জন্য ১৭ বার সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এবার ১৮ বারের মতো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ১৯৮৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আমিনুর রহমান খানের নেতৃত্বে কমিশনের সুপারিশগুলো অনেক প্রশংসিত হয়েছিল। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেই রিপোর্টটি অনেক বেশি যুগোপযোগী এবং বাস্তবতার নিরিখে করা হয়েছিল। তবে সেগুলোর একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। সেখানে পুলিশের দুর্নীতির খাতগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে তা বন্ধ করার সুপারিশগুলো সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছিল। জমা দেওয়া প্রতিবেদনে কমিউনিটি পুলিশিংকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পুলিশ এবং জনগণের মধ্যে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স করার জন্য দর্পণ হিসেবে কাজ করবে। এ ছাড়া প্রতিটি থানায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও উন্নতির জন্য নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। নাগরিক সচেতনতা তৈরির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গঠনমূলক পাঠ্যসূচিতে পুলিশিংয়ের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে জন্য বলা হয়েছে। জুলাই আগস্টে যারা আহত হয়েছে, তাদের সক্ষমতা, যোগ্যতা বিবেচনা করে পুলিশ বিভাগে কর্মসংস্থানের জন্য বলা হয়েছে। মাদক-সংশ্লিষ্ট অপরাধ দমনে নিয়োজিত সংস্থাগুলো একটি সমন্বিত সফটওয়্যার বা ডাটাবেজ তৈরির জন্য বলা হয়েছে। সব বিভাগীয় শহরে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবরেটরি, অটোমেটেড ডিএনএ ল্যাব স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিটি বিভাগে একটি করে ক্রাইম সিন বা ব্যালাস্টিক শাখা গঠন করার জন্য বলা হয়েছে। জানা গেছে, সংস্কার কমিশনের জরিপে, বিক্ষোভ মিছিল মোকাবিলা ও বিরোধী দলমত দমনে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে মানবাধিকার লঙ্ঘন ফৌজদারি অপরাধ বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের শাস্তি চেয়েছেন ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ (প্রায়) উত্তরদাতা। ৬৮ দশমিক ৮ শতাংশ উত্তরদাতা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিস্থাপিত প্রমিত পদ্ধতি (এসওপি) অনুসরণকে প্রবিধানভুক্ত করার পক্ষে মত দেন। জরিপে পুলিশকে জবাবদিহি ও বিভিন্ন প্রভাবমুক্ত রাখতে একটি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বা কমিশনের পক্ষে ৫৮ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা মত দেন।