দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ব্যক্তিগত স্বার্থে সাংবিধানিক ও আইনগত ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ লেনদেনকে অবৈধ ঘোষণা এবং আইনে কালো টাকা সাদা করার বৈধতা স্থায়ীভাবে বন্ধ করাসহ ৪৭ দফা সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশন। এ ছাড়া দুর্নীতি দমনে সব সেবামূলক খাত স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেশনের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে। গতকাল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন আকারে এসব সুপারিশ জমা দেওয়া হয়েছে। পরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তার মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন অন্যতম। ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে এ কমিশন গত ৩ অক্টোবর কার্যক্রম শুরু করে। কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, বেসরকারি খাতে ঘুষ লেনদেন এখন পর্যন্ত অবৈধ নয়। আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের আওতায় সরকারি খাতের মতো বেসরকারি খাতেও ঘুষ লেনদেন অবৈধ। কিন্তু সেটা এখনো কার্যকর হয়নি। এ জন্য দুদককে শক্তিশালী, কার্যকর ও ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে কমিশনারদের পদ বাড়ানো, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সার্চ কমিটি গঠন, বেতন বৃদ্ধি ও প্রণোদনার জন্য সুপারিশ করেছে কমিশন। এ ছাড়া দুদককে শক্তিশালী করতে কয়েকটি আইন সংস্কারের কথা বলেছে কমিশন। যে দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করেন, তার সুরক্ষায় আইন করতে হবে। এ জন্য তথ্য প্রকাশ সুরক্ষা আইনটি সংশোধন করে কার্যকর ও প্রচার করার সুপারিশ করা হয়েছে। সংস্কার কমিশন মনে করে দুদকে শুধু আমলাদের নিয়োগে যে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তা থেকে সরে আসতে হবে। যেসব পেশা দুদকের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা যুক্ত সেখান থেকে দুদকের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিতে হবে। সংস্কার কমিশন চায় দুদক স্বাধীন ও কার্যকর হোক। তবে দুদকের কোনো স্বাধীনতা সীমাহীন নয়। দুদক যে কাজ করবে, তার জবাবদিহি থাকবে। কেউ যাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে না পড়েন, সে জন্য কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে নজরদারি অব্যাহত রাখার সুপারিশও করেছে কমিশন। সংস্কার কমিশন বলছে, দেশে জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী কোনো কৌশল নেই। দুর্নীতি দমন শুধু দুদকের একার কাজ নয়, এখানে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রয়েছে। যেমন সংসদ, আইন ও বিচার বিভাগ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিভিন্ন কমিশন, ব্যবসা খাত ও রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের দুর্নীতিবিরোধী ভূমিকা থাকতে হবে। যে জাতীয় কৌশল প্রণয়নের কথা বলা হচ্ছে, তাতে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নির্ধারণ করা থাকবে। যার মাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপগুলো কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে- সেটি নিয়মিতভাবে নজরদারি করতে হবে। সংস্কার কমিশন মনে করে সুনির্দিষ্ট কিছু আইন না থাকায় অর্থ পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। কারণ যে ব্যক্তি একটি প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন, তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থ ও বন্ধুত্বের বলয় থেকে সিদ্ধান্ত নেন। এটা বন্ধে স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিরসন আইন দরকার। এতে বলা হয়, বেনামি প্রতিষ্ঠান গড়ে এস আলম কয়েকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কারণ বেনামি কোম্পানির তথ্য প্রকাশ করা হয় না। এমনকি অনেক সময় কর্তৃপক্ষের জানার সুযোগ থাকে না। তাই বেনামি প্রতিষ্ঠানের মালিকানার তথ্য একটা জাতীয় রেজিস্ট্রারে উল্লেখ থাকা উচিত। সেটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে। কমিশন দেশের প্রত্যেক নাগরিকের দেশ-বিদেশে থাকা ব্যাংক হিসাবের লেনদেন ‘কমন রিপোর্টি প্র্যাকটিসের আওতায় আনার কথা বলেছে। এর মাধ্যমে বিএফআইইউসহ (বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব লেনদেনের তথ্য জানতে পারবে। এটি বার্ষিক প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করতে হবে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানসহ ১২২টি দেশ ইতোমধ্যে ওই প্র্যাকটিসের অধীন এসেছে, বাংলাদেশ এখনো হয়নি। সুপারিশে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি আয়-ব্যয় নিয়মিত প্রকাশের ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কমিশন বলেছে, রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি আয়-ব্যয় নিয়মিত প্রকাশ করতে হবে। হলফনামার তথ্য প্রকাশ করতে হবে। স্থানীয় থেকে জাতীয়-সব পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে তাঁদের পরিবারের সবার সম্পদের বিবরণী নির্বাচন কমিশনে জমা দেবেন। সেটি নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করবে। এটি প্রতিবছর হালনাগাদ করতে হবে, যত দিন তারা জনপ্রতিনিধি থাকবেন।
রাজনৈতিক বিবেচনায় দুদকে নিয়োগ বন্ধে সাত সদস্যের বাছাই কমিটি করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। সেখানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, পরে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তি যিনি রয়েছেন, তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাছাই কমিটির প্রধান করার কথা বলা হয়েছে। এরপর সদস্য হবেন হাই কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, হিসাব মহানিয়ন্ত্রক (সিজিএ), সংসদ নেতার মনোনীত একজন, প্রধান বিরোধী দল থেকে মনোনীত একজন। এ ছাড়া একজন সরাসরি প্রধান বিচারপতি থেকে নিযুক্ত হবেন, যার দুর্নীতিবিরোধী কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
