সারা দেশে বাড়ছে নানা অপরাধ। চাঁদাবাজি, দখল, ছিনতাই, মব জাস্টিস, সাইবার ক্রাইম, প্রতারণা, আত্মহত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে দেশের মানুষ শঙ্কিত। কোনোভাবেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সীমিত সামর্র্থ্য দিয়ে পুলিশ চেষ্টা করলেও অনেক ক্ষেত্রে এ বাহিনীর সদস্যরা অসহায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, সামান্য অপরাধেও মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছে মানুষের অসহিষ্ণু হয়ে ওঠার। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া, দায়িত্বশীলদের জবাবদিহির অভাব এ ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন তাঁরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ‘৫ আগস্টের পর পুলিশ একটা ট্রমার মধ্যে ছিল। এখনো পুরো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তবে পরিস্থিতি আগের থেকে অনেকটাই উন্নতির দিকে। ছিনতাই বেড়েছে। তবে ছিনতাই-ডাকাতি রোধে পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও জনমনে স্বস্তি ফেরাতে কমিউনিটি পুলিশকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে।’
১ জানুয়ারি রাত দেড়টার দিকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ঢাকা থেকে গাজীপুরের শ্রীপুরে নিজ বাড়ি ফেরেন হাসিবুল ইসলাম (৪০)। বাসার সামনে গাড়ি দাঁড় করানোর পরপরই ৮-১০ মাদকাসক্ত কিশোর গাড়ির ভিতরে তাঁর স্ত্রী, শ্যালকের স্ত্রীকে দেখে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি শুরু করে। বাধা দিতে গেলে তারা হাসিব এবং তাঁর শ্যালক হানিফ ও গাড়িচালক শিমুলের ওপর হামলে পড়ে। জীবন রক্ষায় বাড়ির ভিতর ঢুকেও বাঁচতে পারেননি হাসিব। ২২ জানুয়ারি মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে রুবেল (৩২) নামে এক যুবককে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল জাদুরানী বাজারের একটি বট গাছে দুই হাত বেঁধে ঝুলিয়ে নৃশংসভাবে পেটানো হয়। একপর্যায়ে তার দেহ নিথর হয়ে পড়ে। গুরুতর অবস্থায় হরিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। রুবেল স্থানীয় গোগর গ্রামের পটুয়াপাড়ার মো. খলিলের ছেলে।
কেবল ওপরের দুটি ঘটনা নয়। এমন ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। খোদ রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব এলাকায় সাম্প্রতিককালে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালীদের মদতে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া হালে জামিনে মুক্তি পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীরা আবারও তৎপর হয়ে পড়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে সারা দেশে ডাকাতি, চুরি, দস্যুতা, সিঁধেল চুরির মামলা বেড়েছে। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ডাকাতি মামলা বেড়েছে ২০টি। সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর ও নভেম্বরে বেড়েছে আরও বেশি।
জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় সবচেয়ে বড় অস্বস্তি তৈরি করেছে ছিনতাই। যত্রতত্র ছিনতাই হচ্ছে। পুলিশ ও ঢাকার আদালতের তথ্যানুযায়ী, ঢাকার ৫০ থানা এলাকায় ১ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ দিনে অন্তত ৩৪ জন ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মামলা করেছেন। এ সময় একজন ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন। গুরুতর জখম হয়েছেন আরও চারজন। ৫ আগস্ট থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে ছিনতাইকারীর হামলায় নিহত হয়েছেন সাতজন। ১৮ ডিসেম্বর মেয়র হানিফ উড়ালসড়কে ছিনতাইকারীর হামলায় নিহত হন কামরুল হাসান। ১৫ ডিসেম্বর মগবাজারে হাবিব উল্লাহ নামে এক তরুণ ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। গত বৃহস্পতিবার রাতে কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধ এলাকায় সজল রাজবংশী নামে ব্যবসায়ীকে গুলি করে প্রায় ৭০ ভরি স্বর্ণ ছিনতাইয়ে অংশ নেওয়া দুর্বৃত্তরাও কিশোর বয়সি।
এদিকে, ফেসবুকে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে সাইবার বুলিংয়ের অভিযোগে দুটি পেজ পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। বৃহস্পতিবার ঢাকার শাহবাগ থানায় এ মামলা করেন। এর আগে ১১ জানুয়ারি একটি পেজ থেকে প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছেন এমন গুজব ছড়ানো হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, ‘সাধ্যানুযায়ী অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্যও আমাদের বিশেষায়িত টিম কাজ করে যাচ্ছে। নিয়মিত প্যাট্রোলিং করা হচ্ছে সাইবারজগৎ।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি অপরাধের সঙ্গে যারা জড়াচ্ছে তার বেশির ভাগই তরুণ বা কিশোর। তারা চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি কিংবা মব জাস্টিস বা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। কারও কোনো আচরণ পছন্দ না হলে কিংবা আগের অভিযোগ বা ক্ষোভ থেকে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে সুযোগ বুঝে প্রতিশোধ নিতে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। অন্যের অধিকারের প্রতি সম্মান না দেখানোয় সমাজে জটিলতা তৈরি হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘জনগণের ভাষা, চাহিদা বা আশা-আকাক্সক্ষা গণতান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোকে বর্তমান ও আগামী রাজনীতির বিষয়ে জনগণকে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। জনগণ যখন দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এসব বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাবে তখন এ ধরনের গুজব অনেকটাই কমে যাবে।’