রাজনৈতিক বলয়মুক্ত হয়ে জনগণের পুলিশ হিসেবে ভূমিকা রাখার অঙ্গীকারসহ একগুচ্ছ প্রত্যাশা নিয়ে শেষ হয়েছে পুলিশ সপ্তাহ-২০২৫। গতকাল রাজারবাগে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটরিয়ামে বাংলাদেশ পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতির (পুনাক) সমাবেশ, আনন্দমেলা, স্টলের পুরস্কার বিতরণীর মাধ্যমে শেষ হয় এবারের পুলিশ সপ্তাহ।
পুলিশের সংস্কার, রাজনৈতিক বলয়মুক্ত হতে স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশন গঠন, বিবাহিতদের এএসপি পদে নিয়োগ না দেওয়া, সর্বস্তরে ওভারটাইম ভাতাসহ একগুচ্ছ দাবি ওঠে এবারের পুলিশ সপ্তাহে। একই সঙ্গে বিভিন্ন ইউনিট তাদের প্রেজেন্টেশনে সংকট, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরে।
নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে উঠে আসে জনতার পুলিশ হতে করণীয় নানা দিক। জনতার পুলিশ হতে বাধাগুলোও তুলে ধরা হয় ওই সভায়। জনতার পুলিশ হওয়ার পথ পাড়ি দেওয়া ছাড়াও দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আরও একগুচ্ছ দাবি ও সেগুলো বাস্তবায়নের প্রত্যাশা উঠে আসে সংশ্লিষ্টদের আলোচনায়।
‘নাগরিক ভাবনায় জনতার পুলিশ : নিরাপত্তা ও আস্থার বন্ধন’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, পুলিশ দলীয় পুলিশ হয়ে যায়, সেটা তো বাহ্যিক। কিন্তু ভিতরে সমস্যা আছে। শুধু তাই নয়, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন ও বিধিতেও পদে পদে সমস্যা আছে। সর্বশেষ যে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন, তারাও বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন, আমরা পুলিশকে যেভাবে মিসইউজ করি, বিরোধীদল দমনের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাওয়ার্ড দেওয়াসহ সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে যদি পুলিশকে সংস্কার না করতে পারি তাহলে এই পুলিশকে কেবল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতেই সক্ষম হব, রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করাতে সক্ষম হব না। পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন মনে হয়েছে এটি একটি ত্রুটিযুক্ত কমিশন। বাংলাদেশ পুলিশ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করবে সেটিই দেখতে চাই। জবাবদিহিতার জায়গা ইফেক্টিভ করতে পারলে পুলিশ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারবে।
রাজনৈতিক প্রভাব থেকে দূরে থেকে পুলিশ সদস্যদের কাজ করার আহ্বান জানান নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. জাহেদ উর রহমান। সাবেক আইজিপি আবদুল কাইয়ুম বলেন, সবাই তেলবাজি করি। মন্ত্রী-এমপিদের বাসায় যাই। ব্যক্তিগত লাভ ও পদোন্নতির জন্য নানান রকম অবৈধ কাজে লিপ্ত হয়ে যাই। এটি দ্বিচারিতা, এর অবসান হওয়া উচিত। সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, পুলিশ সংস্কার কমিশন পুলিশের বিষয়ে যা বলছে অনেক বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার। পুলিশ কমিশন ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন নিয়ে কিছু বলেনি। যেভাবে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছেন পুলিশ অফিসাররা এটা চিন্তার বাইরে। এখনো যে দুর্নীতি হচ্ছে না এই গ্যারান্টি নেই। দুর্নীতি থেকে পুলিশকে বেরিয়ে আসতে হবে। আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, পুলিশ যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের পাশে থাকে, তবে তারা ভয়ের প্রতীক নয় বরং হয়ে ওঠে ভরসার আশ্রয়। তাই পুলিশ হতে হবে এমন, যারা থাকবে জনগণের পাশে, জনগণের হয়ে, জনগণের জন্য। পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত আইজি (এসবি) গোলাম রসুল বলেন, আমরা জনতার মুখোমুখি থাকব না, পাশাপাশি থাকব। আমরা সাধারণ মানুষের কাছে যেতে চাই; জনগণের পুলিশ, সাধারণ মানুষের পুলিশ হতে চাই। গত মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধন করেন এবং পদকপ্রাপ্ত ৬২ জনকে পদক পরিয়ে দেন। ওই দিনই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময় ও প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনার আলোকে প্রণীত কর্মপরিকল্পনার ওপর ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দিনের কার্যক্রম শেষ হয় পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে। দ্বিতীয় দিনে প্রেজেন্টেশন দেয় সিআইডি, র্যাবসহ পুলিশের ১০টি ইউনিট। ওই দিন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিবদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তৃতীয় দিনের কার্যক্রম শুরু হয় পুলিশ সদস্যদের আইজি ব্যাজ প্রদানের মাধ্যমে।
এরপর আইজিপির সঙ্গে সম্মেলন শেষে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় ‘নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা’। ওই দিনই বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ও পুলিশ অফিসার্স মেসের বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। তৃতীয় দিনের কার্যক্রম শেষ হয় অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত পুলিশ সদস্যদের পুনর্মিলনীর মাধ্যমে।