উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে গতকাল তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আইন অনুমোদন হয়েছে জানিয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে পূর্বের আইনের (সাইবার নিরাপত্তা আইন) নয়টি কুখ্যাত ধারা বিলুপ্ত করা হয়েছে। এই ধারাগুলোয় ৯৫ শতাংশ মামলা দায়ের হয়েছিল। অনেক হয়রানিমূলক মামলা হতো। মামলাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানাতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
আসিফ নজরুল বলেন, জাতীয় সংসদের নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ ও কোড অব সিভিল প্রসিডিউরের (সিপিসি) সংশোধনী চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করা হয়েছে। এ ছাড়া সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপন করা হয়। একটা সংশোধনীর প্রস্তাব এসেছে। আশা করছি, সংশোধনীর পর আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে এ সপ্তাহের মধ্যে গেজেট নোটিফিকেশন হয়ে প্রয়োগযোগ্য আইনে পরিণত হবে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ইচ্ছামতো নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভিযোগ আছে। নির্বাচন কমিশনের অনুরোধে আমরা আইনটা সংশোধন করে দিয়েছি। এ ছাড়া বাংলাদেশে সিভিল মামলা নিষ্পত্তি হতে যুগের পর যুগ লাগে। এজন্য এই আইনে অনেকগুলো পরিবর্তন এনে কোড অব সিভিল প্রসিডিউরের (সিপিসি) সংশোধনী অনুমোদন করা হয়েছে। আগে ইচ্ছামতো মামলার শুনানি মুলতবি করা যেত। এখন আর তা করা যাবে না। আগে সিপিসির মামলায় শুধু আর্জি ও লিখিত বিবৃতি আদালতে মৌখিকভাবে উত্থাপন করতে ২-৩ বছর পার হতো। এখন থেকে লিখিত বিবৃতি মৌখিকভাবে উপস্থাপন করা লাগবে না। আগে মামলার রায় পাওয়ার পর বাস্তবায়নের জন্য আবার আলাদা মামলা করতে হতো। সেটাও আর লাগবে না। সমন জারিসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া আরও সহজ করেছি।
এদিকে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে আগের আইনের নয়টি কুখ্যাত ধারা বিলুপ্ত করা হয়েছে জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা সম্পর্কিত বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণা-সংক্রান্ত বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে। মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের জন্য দণ্ডের বিধান বাতিল করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে এমন কনটেন্ট বা কথাবার্তা বলা নিয়ে প্রচুর মামলা হতো। এই ধারা বাতিল করা হয়েছে। বিলুপ্ত ধারাগুলোয় দায়েরকৃত মামলাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। অধ্যাদেশে প্রথমবারের মতো ইন্টারনেটকে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অনলাইন জুয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাইবার স্পেসে নারী-শিশু নির্যাতন ও যৌন হয়রানিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, নতুন অধ্যাদেশে মতামত প্রকাশের মাধ্যমে মাত্র দুটি অপরাধ রাখা হয়েছে। একটা হচ্ছে নারী ও শিশুর প্রতি যৌন হয়রানিমূলক কনটেন্ট প্রকাশ ও হুমকি দেওয়া। আরেকটি হচ্ছে কনটেন্টের মাধ্যমে ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানোর মাধ্যমে সহিংসতাকে উসকে দেওয়া। নতুন আইনে স্পিচ অফেন্স, অর্থাৎ কথা বলার মাধ্যমে যে অপরাধগুলো করা হতো, তার সব জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রে কঠিন সাজার বিধান রাখা হয়েছে।
ধর্মীয় চাপে সরকার নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন বাতিল করবে কি না- এমন প্রশ্নে আইন উপদেষ্টা বলেন, যে কোনো ধরনের বড় সংস্কার রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া বাস্তবায়ন করা হবে না। নারী সংস্কার কমিশন একটা প্রস্তাব দিয়েছে। এটা সরকারি সিদ্ধান্ত না। আমাদের সব সংস্কার কমিশনের সুপারিশেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নমত এসেছে। নারী সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে ভিন্নমত থাকতেই পারে। তবে এখানে অত্যন্ত বিদ্বেষমূলক, আক্রমণাত্মক এবং শুধু নারী নয়, পুরো জাতির প্রতি অবমাননাকরভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। আমরা আশা করব ভিন্নমত প্রকাশের ক্ষেত্রে সবাই যেন সহনশীলতা ও শালীনতার পরিচয় দেয়।
আসিফ মাহমুদ বলেন, আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় কর্মসংস্থানের ঘাটতি রয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ২২ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি মিলে ১২ লাখের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। বেকারত্ব কমাতে তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে তাদের সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে জাতীয় যুব উদ্যোক্তা উন্নয়ন নীতিমালা-২০২৫ উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন পেয়েছে। এর মাধ্যমে উদ্যোক্তা উন্নয়ন সহজ হবে ও একটা কাঠামোর মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করতে পারবে সরকার।
সংবাদ সম্মেলনে শফিকুল আলম বলেন, চট্টগ্রামের বাঁশখালিতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে বাংলাদেশ এনার্জি পোর্ট লিমিটেড নামের কোম্পানি গঠনের প্রস্তাব কমিটিসহ বাতিল করা হয়েছে। বেক্সিমকো ও মাল্টার একটা কোম্পানি মিলে এটা করতে চাচ্ছিল। দেশে উৎপাদিত আঁশ তুলাকে কৃষিপণ্য ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা করা হয়েছে।