দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বুধবার গভীর রাত থেকে গতকাল ভোর পর্যন্ত আরও ৯০ জনকে পুশইন করেছে। এর মধ্যে ফেনী সীমান্ত দিয়ে ২৪ জন, পঞ্চগড় দিয়ে ২১ জন, লালমনিরহাট দিয়ে ২০ জন, কুমিল্লা দিয়ে ১৩ জন, মৌলভীবাজার দিয়ে সাতজন ও খাগড়াছড়ি সীমান্ত দিয়ে পাঁচজনকে পুশইন করা হয়। এদের মধ্যে খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় সীমান্ত থেকে পাঁচজনকে উদ্ধার করেছে বিজিবি। যাদের ফেনী নদী দিয়ে বিএসএফ ভাসিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। আমাদের ফেনী প্রতিনিধি জানান, সীমান্তে ২৪ বাংলাদেশিকে পুশইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। গতকাল ভোর রাতে ফেনীর ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজী উপজেলার খেজুরিয়া সীমান্ত দিয়ে তাদের পুশইন করা হয়।
বিজিবি জানায়, ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজী উপজেলার যশপুর এবং খেজুরিয়া বিওপির দায়িত্বপূর্ণ সীমান্ত দিয়ে ছয়টি পরিবারের ২৪ বাংলাদেশি নাগরিককে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয় বিএসএফ। সংবাদ পেয়ে বিজিবি ও পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাদের আটক করে। তারা প্রত্যেকেই কুড়িগ্রামের বাসিন্দা বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। ২৪ জনের মধ্যে ছয়জন পুরুষ, পাঁচজন নারী ও ১৩ জন শিশু রয়েছে। আটককৃতদের ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজী থানায় হস্তান্তর করা হয়। ফেনী ৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার ভোর রাতে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় ২৪ জনকে আটক করা হয়। পরে তাদের থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, সীমান্ত দিয়ে ২১ বাংলাদেশিকে পুশইন করেছে বিএসএফ। গতকাল ভোর ৪টার দিকে সদর উপজেলার চাকলাহাট ইউপির জয়দর ভাঙ্গা বিওপি এলাকায় ২১ বাংলাদেশিকে ঠেলে দেয় বিএসএফ। পরে জয়দর ভাঙ্গা সীমান্ত পিলার ৭৫৭/১০-এস হতে আনুমানিক ২.৫ কিলোমিটার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বড়বাড়ী নামক স্থান থেকে বিওপির বিশেষ টহল দল ২১ জনকে আটক করে বিজিবি। আটককৃতরা হলেন খুলনার আলেয়া (৫৫), শিমা (৩০), স্বপ্না (২৯), রব্বি ফকির (২২), শিমলা (১৯), ফারজানা (১২), আফসানা (৯), রোজিনা (৮), ইসমাইল (৫), মরিয়ম (৩), আলিশা (৩), হেলেনা (২৭), আয়ান (৩ মাস), নড়াইলের রোজি (৩৯), রানা (১৭), কুলসুম (১০), রহমান (৬), রেহমান (৫), আয়েশা (৪), আফরিন (৩) ও রেহমাত আলী (২)। নীলফামারীর ৫৬ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শেখ মো. বদরুদ্দোজা ২১ জন বাংলাদেশিকে পুশইন করার কথা স্বীকার করেছেন।
কুমিল্লা : জেলার সীমান্ত দিয়ে ১৩ জনকে ঠেলে পাঠিয়েছে বিএসএফ। ভোর ৪টার দিকে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার গোলাবাড়ী সীমান্ত থেকে নারী, পুরুষ, শিশুসহ ওই ১৩ জনকে আটক করে বিজিবি। বিজিবির কুমিল্লা ব্যাটালিয়নের (১০ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর আলী এজাজ এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। বিজিবি সূত্রে জানা যায়, ভোর ৪টার দিকে গোলাবাড়ী সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে বিএসএফ নারী-শিশুসহ ১৩ জনকে ঠেলে পাঠায়। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় ৬০ বিজিবির একটি টহল দল তাদের আটক করে। তাদের মধ্যে পুরুষ তিনজন, নারী তিনজন ও ৭টি শিশু। বিজিবির কুমিল্লা ব্যাটালিয়নের (১০ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর আলী এজাজ জানান, কুমিল্লা ও ফেনী জেলার সীমান্ত দিয়ে রাতের আঁধারে সর্বমোট ৫২ বাংলাদেশি নাগরিক পুশইন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৯ জন পুরুষ, ১৫ জন নারী এবং শিশু ও কিশোর ১৮ জন। অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় ওই ৫২ জনকে আটক করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তাদের বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশে পুশইন করা হয়েছে।
লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, জেলার পাটগ্রাম উপজেলার দুটি সীমান্ত দিয়ে ২০ জনকে পুশইন করেছে ভারত। পুশইনের শিকার শিশু, নারীসহ ২০ জনকে আটকের পর থানায় দিয়েছে বিজিবি। বুধবার দিবাগত রাতে পাটগ্রাম উপজেলার দুটি সীমান্ত দিয়ে তাদের পুশইন করে বিএসএফ। আটককৃতদের মধ্যে সাত শিশু, ১১ নারী ও দুজন পুরুষ রয়েছেন।
বিজিবি জানিয়েছে, বুধবার রাতে বিএসএফ ও ভারতীয় পুলিশ পাটগ্রামের গাটিয়ার ভিটা ও ঝালাঙ্গি সীমান্ত দিয়ে পুশইন করে ওই ২০ জনকে। পরে বিজিবি ও স্থানীয়রা তাদের আটক করে। আটককৃতরা পুলিশকে জানিয়েছে, ভারতের আহমেদাবাদ থেকে গতকাল তাদের বিমানে শিলিগুড়ির বাগডোগড়া বিমানবন্দরে আনা হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন সীমান্তে এনে পুশইন করা হয়। এর আগে গত ২৬ এপ্রিল গুজরাট থেকে তাদের আটক করা হয়। আটকৃতরা নিজেদের বাংলাদেশি দাবি করেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। তাদের বাড়ি খুলনা, নড়াইল ও যশোর জেলায়।
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের মুরইছড়া সীমান্ত দিয়ে শিশুসহ সাত বাংলাদেশিকে ফের পুশইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, পুশইনের পর তুতবাড়ি সংলগ্ন এলাকায় স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে খবর পেয়ে বিজিবির সদস্যরা ওই সাতজনকে আটক করেন। আটককৃতদের মধ্যে দুজন পুরুষ, দুজন নারী ও তিন শিশু রয়েছে। তারা সবাই কুড়িগ্রাম জেলার বাসিন্দা।
এ বিষয়ে ৪৬ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ এস এম জাকারিয়া বলেন, আটক ব্যক্তিরা সবাই বাংলাদেশি নাগরিক। আমরা তাদের কুলাউড়া থানায় হস্তান্তর করেছি। উল্লেখ্য, এর আগে গত ১৫ মে একই সীমান্ত দিয়ে পুশইনের শিকার হয়ে ১৪ জন বাংলাদেশিকে আটক করা হয়েছিল। খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, জেলার রামগড় সীমান্ত থেকে পাঁচজনকে উদ্ধার করেছে বিজিবি; যাদের ফেনী নদী দিয়ে বিএসএফ ভাসিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। গতকাল সকাল ৬টার দিকে রামগড় বিজিবি-৪৩ ব্যাটালিয়নের মহামুনি বিওপির সদস্যরা অনুপ্রবেশের অভিযোগে তাদের আটক করে। এর আগে বুধবার মধ্যরাতে রামগড়-সাব্রুম সীমান্তের ফেনীরকুল কাজীরচর সীমান্ত দিয়ে বিএসএফ তাদের ‘পুশইন’ করে বলে জানান রামগড় উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইসমত জাহান তুহিন। আটকরা হলেন- উমেদ আলী (৪২), তার স্ত্রী সেলিনা বেগম (৩৫) এবং তাদের ১৫, ১২ ও ৮ বছরের তিন মেয়ে। তারা কুড়িগ্রামের চর সুপার কুটি গ্রামের বাসিন্দা বলে জানা গেছে।
ফেরত আসা উমেদ আলী সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন তারা। তাদের আটকের পর ‘হাত-পা বেঁধে’ সীমান্তের কাছে আনা হয়। তাদের কাছে থাকা টাকা-পয়সা ও মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘বুধবার রাত ১২টার দিকে মারধর করে জোরপূর্বক নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। নদীতে ফেলার আগে তাদের কোমরে প্লাস্টিকের খালি বোতল বেঁধে দেওয়া হয়। এতে তারা পানিতে ভাসতে ভাসতে সীমান্তে চলে আসেন।’
ভোর ৫টার দিকে তারা বাংলাদেশে নদীর কিনারে ভেড়েন। পরে নদী তীরবর্তী গ্রামবাসীদের সহায়তায় তারা সোনাইপুল এলাকায় পৌঁছান। সেখান থেকে তাদের আটক করে নিয়ে যায় বিজিবি।
ইউএনও ইসমত জাহান তুহিন বলেন, মানবিক কারণে তাদের রামগড় হাই স্কুলে বিজিবি ও পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়েছে। তাদের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে। শনাক্ত শেষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে ৬ মে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা ও পানছড়ি সীমান্ত দিয়ে ৮১ জনকে বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করে বিএসএফ।