জুলাই বিপ্লবের পর সবার প্রত্যাশা ছিল এক নতুন বাংলাদেশের, যে বাংলাদেশ হবে ঐক্যের, বৈষম্যমুক্তির। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার বাংলাদেশ, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ। যেখানে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা হবে না। সহিংসতা, সন্ত্রাস রাজনীতির সুস্থ ধারাকে গ্রাস করবে না। একে অন্যকে নিঃশেষ করে দেওয়ার ঘৃণ্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে না। আমরা এমন একটা বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, যে বাংলাদেশে সব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৌভ্রাত্র থাকবে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। তারা একে অন্যের সঙ্গে নানারকম রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধিতা করবে, কিন্তু সেটা সুস্থ, সুন্দর প্রক্রিয়ায়। রাজনীতিতে শিষ্টাচার, সৃজনশীলতা এবং পরস্পরের প্রতি সম্মান প্রতিষ্ঠিত হবে। যেটা গত ১৫ বছরে নির্বাসিত ছিল। সেরকম একটা বাংলাদেশের স্বপ্ন বুকে ধারণ করে ছাত্র-জনতা লড়াই করেছিল। এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছে। আর এই নতুন বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে, এক বছর আগে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হবে একটি পরিবার। এখানে আমরা একে অন্যের ভাই, কেউ কারও শত্রু না।’ আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশ গড়ব। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও একই ধরনের প্রত্যয় আমরা লক্ষ্য করেছিলাম। সব রাজনৈতিক দলগুলো বলেছিল, যে কোনো মূল্যে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সবার আগে দেশ, দেশের প্রশ্নে বিভেদ রাখা চলবে না। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে, বিশেষ করে জুলাই গণ অভ্যুত্থানের এক বছর পর আমরা দেখতে পাচ্ছি রাজনীতির আকাশে বিভেদের ঘনঘটা। এ বিভেদ এখন প্রতিহিংসায় রূপ নিচ্ছে। ছোটখাটো ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যকে আক্রমণ করছে, নানারকম কুৎসিত বাক্যবাণে রাজনীতির মাঠ এখন কলুষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শুধু রাজনীতি না, সর্বত্র আমরা দেখছি এক ধরনের চোর-পুলিশ খেলা চলছে। কে ফ্যাসিবাদের দালাল ছিল কে, কে সুবিধাভোগী ইত্যাদি খোঁজার নামে যেন বাংলাদেশকে নতুন করে বিভক্ত করার চেষ্টা চলছে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমরা যতক্ষণ বিভেদের রাজনীতি করব, ততক্ষণ জুলাই বিপ্লব সফল হবে না। বাংলাদেশ এগোতে পারবে না। দেশের বেশির ভাগ মানুষ কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের চিন্তাভাবনাকে লালন করেন না। তারা দেশকে ভালোবাসেন, দেশের জন্য কাজ করেন। যিনি সরকারে থাকেন তার নির্দেশ তাকে মানতে হয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে একপক্ষ অন্যপক্ষকে নানা রকম ট্যাগ লাগিয়ে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে যখন নির্বাচনের সময় সামনে এসেছে, তখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ যেন প্রকট আকার ধারণ করেছে। ছোট ছোট বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে বিভেদ দেখা দিচ্ছে, তা বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং অগ্রযাত্রাকেই বাধাগ্রস্ত করবে। গণতন্ত্রের উত্তরণকে করবে জটিল। প্রধান উপদেষ্টা জুলাই ঘোষণাপত্র ৫ আগস্টে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে মতবিরোধ ছিল মতপার্থক্য ছিল, কিন্তু তারপরও তারা সবাই এটা মেনে নিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা করেছিলেন, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হবে। এই ঘোষণার পর প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলো ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে নির্বাচন নিয়ে নানামুখী তৎপরতা। এই তৎপরতার কারণ আমরা সবাই জানি। কে, কেন, কী উদ্দেশে রাজনীতির বিভক্ত সৃষ্টি করছে তা সাধারণ জনগণের অজানা নয়। আমরা দেখেছি এনসিপি নির্বাচনের ব্যাপারে নানারকম শর্ত আরোপ করছে। বিচার বা সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া এমন একটি বিষয়, যাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। এটি স্বচ্ছ এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হওয়া উচিত। এই বিচার প্রক্রিয়া যেন নিরপেক্ষ হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ গোটা বিশ্ব এই বিচার দেখছে। এই বিচারে যদি কোনোরকম তাড়াহুড়া বা প্রহসন হয় সেটি জুলাই বিপ্লবকেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এনসিপি নির্বাচনের ব্যাপারে নেতিবাচক অবস্থান কেন নিয়েছে, তা বুঝতে আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকদের কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কারণ তাদের সংগঠন এখনো গোছাতে পারেনি। সদ্য ভূমিষ্ঠ এই রাজনৈতিক সংগঠনটি এখন নানা রকম সংকটে জর্জরিত। দলের নেতা-কর্মীদেরকে নানা অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হচ্ছে। আবার এই নোটিস প্রত্যাহারও করে নেওয়া হচ্ছে নানা চাপে। দলের ভিতর নানা রকম অসন্তোষ, ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠছে। যে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ছাত্ররা জুলাই বিপ্লব সংগঠিত করেছিল, সেই জনসমর্থনে এখন ভাটার টান। এটি হতেই পারে। রাজনীতিতে জোয়ার ভাটা থাকবেই, কিন্তু মনে রাখতে হবে এনসিপি শুধু নিজেদের স্বার্থের জন্য যদি নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করে, সেটি হবে জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়।’ দেশের স্বার্থ সবার আগে। দেশটাকে আমাদের সবাইকে ভালোবাসতে হবে। দেশের স্বার্থে কাজ করতে হবে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই এনসিপি যে জুলাই বিপ্লব সংগঠিত করেছিল, সেই জুলাই বিপ্লব নিজেদের স্বার্থের জন্য করেনি, নিজেরা ধনী হওয়ার জন্য করেনি বা পদ-পদবির জন্য করেননি। তারা করেছিলেন দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য। আর সেজন্যই দেশের স্বার্থ দেখে তারা রাজনীতিতে নতুন বিভক্তি উসকে দেবেন না বলেই আমরা বিশ্বাস করি। জামায়াত পিআর পদ্ধতির ব্যাপারে হঠাৎ করেই সোচ্চার হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের পর জামায়াতকে পিআর পদ্ধতির ব্যাপারে সোচ্চার দেখা যায়নি। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এই পিআর পদ্ধতি বোঝেই না। সম্প্রতি একটি জরিপে দেখা গেছে ‘দেশের ৮০ ভাগ নাগরিকের পিআর পদ্ধতি সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তাহলে জামায়াত কেন পিআর পদ্ধতি নিয়ে হুলস্থূল করছে।’ এখানেও দেশের স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থ বড় হয়ে উঠেছে। কারণ সারা দেশে জামায়াতের কর্মী সমর্থকরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। জামায়াত মনে করে আসনভিত্তিক নির্বাচন হলে সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জামায়াতের ভোটগুলো তাদের সুবিধা দেবে না। নির্দিষ্ট নির্বাচনি এলাকায় তাদের ভোটাররা ভোট দিলেও তাদের জন্য নির্বাচনে ভালো ফলাফল করা কষ্টসাধ্য হবে। কিন্তু যদি আনুপাতিক হারে আসন বণ্টন হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে ভোটের অবস্থানে তারা এই মুহূর্তে দ্বিতীয় বা তৃতীয় অবস্থানে থাকবে। সংসদে ভালো আসন পাবে, ভোটের হারের ভিত্তিতে। তাই শুধু নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য তারা পিআর পদ্ধতি নিয়ে জেদ করছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ন্যূনতম সচেতনতা নেই, তাই এখনই পিআর পদ্ধতি কি চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে?
জামায়াত তার রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে পিআর পদ্ধতি রাখতেই পারে। পিআর পদ্ধতি নিয়ে জনমত সৃষ্টি করতে পারে। ভোটের মাঠে তারা এই পিআর পদ্ধতির পক্ষে গিয়ে প্রচারণাও করতে পারে। জনগণ যদি মনে করে তারা পিআর পদ্ধতির পক্ষে, তাহলে তারা জামায়াতকে ভোট দেবে। আর যদি জনগণ মনে করে যে, এই পদ্ধতি তাদের বোধগম্য নয়, তাহলে তারা সেই পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করবে। বিষয়টি জোর করে চাপিয়ে না দিয়ে জনগণের ওপর ছেড়ে দেওয়াটাই সবচেয়ে সঠিক কাজ বলে আমি মনে করি। কারণ জুলাই বিপ্লবে জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই বিপ্লবের অন্যতম রূপকার জামায়াত। কাজেই আমরা বিশ্বাস করতে চাই জামায়াত দেশের স্বার্থে এবং জনগণের স্বার্থ সবার আগে দেখবে।
দেশে একটি গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রয়োজন। একটি অন্তর্বর্তী অনির্বাচিত সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একমাত্র এই সরকারের আস্থার প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন। এই সরকারের উপদেষ্টাম লীকে নিয়ে নানারকম বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। অনেকের যোগ্যতা এবং কর্মতৎপরতা নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার যে সব ব্যক্তিবর্গকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়েছেন, সে সব ব্যক্তিবর্গের যোগ্যতা এবং কাজের ধরন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিদিন বিভিন্ন উপদেষ্টা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সম্পর্কে নানা রকম বিতর্ক উঠছে। কারও কারও হানি ট্র্যাপের খবর বাংলাদেশের মানুষকে হতবাক, বিস্মিত করছে। মানুষ ক্রমশ হতাশ হচ্ছে। এরকম অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া দরকার। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো না। একটি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সুদূর প্রসারী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। ব্যাংকগুলো আর্থিক সংকটে ভুগছে। নতুন কর্মসংস্থান নাই। ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে চলছে ‘ব্লেইম গেম’। কে ফ্যাসিবাদের দোসর, কে বিএনপি, কে আওয়ামী লীগ খোঁজা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেন দেশের স্বার্থে, দেশকে এগিয়ে নিতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য তারা তাদের মেধা-মনন উজাড় করে দেন। রাজনৈতিক দলগুলো যদি এই বাস্তবতা অনুধাবন না করেন, তাহলে সেটি হবে দুঃখজনক। এভাবে সর্বক্ষেত্রেই বিভক্তি এবং প্রতিহিংসার উন্মত্ততা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই প্রতিহিংসা এবং বিভেদ থেকে মুক্ত হতে হবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, গত বুধবার বলেছেন, ‘প্রতিহিংসা আর বিভেদ মুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হবে।’ একটি সুশাসনের জবাবদিহিতার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে আমাদেরকে কাজ করতে হবে। আর সেই কাজ করার জন্য অবশ্যই একটা নির্বাচন প্রয়োজন। নির্বাচনে কে জয়ী হবে, কে পরাজিত হবে সেটি মুখ্য বিষয় নয়। সেটা জনগণ নির্ধারণ করবে। কিন্তু দেশে একটি নির্বাচন হতেই হবে। কারণ সবার আগে দেশ। আমরা যদি এই দেশকে ভালোবাসি তাহলে আমাদের বিভেদ ভুলে আমরা একটি নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে ঐক্যবদ্ধ হব। আমাদের মনে রাখতে হবে ঐক্যই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।