পৃথিবীজুড়ে মানুষ আজ আক্রান্ত কভিড-১৯ এ। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে, ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছে মানুষ। এ ধরনের সংকটময় জীবনে বয়স্কদের বিভিন্ন জয়েন্টে বা অস্থিসন্ধির ব্যথাও বেড়ে যাচ্ছে। আগে যারা নিয়মিত মর্নিং ওয়াক করতেন তারা আর সেটা করতে যান না, আগে যারা সন্ধ্যায় নিয়ম মাফিক হাঁটতেন, তারাও এক প্রকার শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছেন। বিভিন্ন অফিস-আদালত খুললেও করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কারণে অন্যান্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার রুটিন নিয়মগুলো মেনে চলা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। অনেকে এ সময় হাসপাতালের আউটডোরে যেতেও ইতস্তত বোধ করেন। চিকিৎসকের চেম্বারে যেতেও নিরাপদ বোধ করেন না। কিন্তু যদি আপনার বিভিন্ন অস্থিসন্ধিতে ব্যথা করে তাহলে এই অনিশ্চিত সময়গুলোতে আপনি কীভাবে ব্যথা থেকে মুক্তি পাবেন? কীভাবে মোকাবিলা করবেন আপনার জয়েন্টের তীব্র, অসহনীয় ব্যথা? এই করোনাকালে আপনার জয়েন্টগুলোকে সুরক্ষা দিতে কিছু পরামর্শ দেওয়া হলো-
প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ করুন : যদি আপনার জয়েন্টে ব্যথা হয়, এটা আপনার শরীরের প্রদাহ থেকে হতে পারে। প্রদাহ জয়েন্ট টিস্যুগুলোকে আক্রমণ করে। এর ফলে আপনার জয়েন্টগুলোর মধ্যে তরল পদার্থ সৃষ্টি হয়, জয়েন্ট ফুলে যায় এবং মাংসপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছু পন্থা অবলম্বন করে আপনি বাড়িতে বসেই এই প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। উদাহরণ স্বরূপ হাঁটুর কথা ধরুন-
তীব্র হাঁটু ব্যথা হলে দুই-তিন দিন পূর্ণ বা আংশিক বিশ্রাম নিন। কিন্তু বিছানায় শুয়ে সম্পূর্ণ বিশ্রাম নেবেন না। হাঁটু ফোলা কমানোর জন্য আপনি হাঁটুতে বরফের ঠা-া সেঁক নেবেন। এক্ষেত্রে আপনি ব্যথার স্থানে ৫-১৫ মিনিট আইসব্যাগ রাখতে পারেন। মনে রাখবেন ত্বকে সরাসরি বরফ রাখবেন না। আইসব্যাগ না থাকলে একটি কাপড়ে বরফ মুড়ে সেটি ব্যথার স্থানে রাখুন।
আপনি বিছানায় শুয়ে পা উঁচুতে রাখুন।
প্রদাহ বিরোধী ওষুধ ব্যবহার করুন : করোনা মহামারীর প্রথমদিকে অনেক রোগী এনএসএআইডি বা ব্যথানাশক ওষুধের কথা জেনেছেন। এই ওষুধগুলো আর্থ্রাইটিস ও জয়েন্টের ব্যথার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। উল্লেখ্য, আর্থ্রাইটিস ও জয়েন্টের ব্যথা কভিড ইনফেকশনকে আরও খারাপ করে তোলে। তবে এমন প্রমাণ নেই যে এনএসএআইডি কভিড-১৯ কে আরও বাড়িয়ে দেয়। এ সময় আপনি জয়েন্টে ব্যথার জন্য এনএসএআইডি যেমন আইবুপ্রফেন বা ন্যাপ্রোক্সেন খেতে পারেন। তবে এসবের বদলে আপনি প্যারাসিটামলও গ্রহণ করতে পারেন। এখন পর্যন্ত প্যারাসিটামল খুবই কার্যকর ওষুধ। সত্যিকার অর্থে কোনো ওষুধটি আপনার জন্য প্রযোজ্য সেটি অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। জয়েন্টে ব্যথার জন্য এবং সেই ব্যথা নিরাময় আপনার ক্ষেত্রে সঠিক ওষুধ কোনটি-সেটা জানতে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন।
যেসব কারণে ব্যথা বাড়ে তা পরিহার করুন : জয়েন্টে আঘাত লাগলে বা অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমে আপনার জয়েন্টে ব্যথা বেড়ে যেতে পারে। জয়েন্টে ব্যথা বেড়ে যাওয়ার আরও কিছু কারণের মধ্যে রয়েছে - চাপ, আবহাওয়া, বারবার হাঁটাচলা করা, ইনফেকশন এবং অতিরিক্ত ওজন। এক্ষেত্রে ব্যথা কমানোর জন্য আপনি যেসব কাজ করবেন তা হলো-
নিচু চেয়ারে বসবেন না। দীর্ঘসময় একটানা হাঁটবেন না। সিঁড়ি দিয়ে উঠানাম করবেন না।
দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকবেন না। শরীর বাঁকিয়ে ফেলতে হয় এমন ব্যায়াম করবেন না।
আর, এ সময়ে সঠিক খাবার গ্রহণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আপনি যেটা খাবেন সেটা সরাসরি শরীরে প্রভাব ফেলে। শারীরিক কাজকর্মের মতো খাওয়া-দাওয়ার দিকে নজর দিতে হবে। অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ করলে ওজন বেড়ে যেতে পারে, এতে জয়েন্টে ব্যথা হবে। আপনার শারীরিক উচ্চতা ও ভর অনুযায়ী ওজন বজায় রাখবেন।
সঠিক ব্যায়াম করুন : কিছু ব্যায়াম বাড়িতে করতে পারেন যা আপনার হিপ ও হাঁটুকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে। হিপ এবং হাঁটুর স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পেশি হলো কোয়াড্রিসেপ মাংসপেশি। এই পেশি আপনার উরুর সামনে থাকে। আপনি হাঁটু সামনের দিকে সোজা করুন বা আপনার পা সামনে সোজা ছড়িয়ে দিন। যদি চেয়ারে বসে আপনার পা হাঁটুর সমান সোজা রাখেন, তাহলে আপনার কোয়াড্রিসেপ পেশির ব্যায়াম হবে। মনে রাখবেন ভুল ব্যায়ামে হাঁটুসহ নানা স্থানে ব্যথা হতে পারে। তাই সঠিক পদ্ধতিতে ব্যায়াম ও বিশ্রাম অতি জরুরি বিষয়।
চিকিৎসকের পরামর্শ নিন : বর্তমান করোনাকালে অনেক অর্থোপেডিক সার্জন টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে পরামর্শ দিচ্ছেন। যদি আপনি সরাসরি না দেখাতে চান তাহলে ভিডিও কল বা ফোনকলের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিতে পারেন। কিন্তু যদি অবস্থা গুরুতর হয় তাহলে বর্তমান স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং অবশ্যই মাস্ক পরে চিকিৎসকের কাছে যাবেন।
লেখক : ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল
সহযোগী অধ্যাপক, অর্থোপেডিক্স ও ট্রমাটোলজি বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা।