মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

মানুষের শরীর কী দিয়ে তৈরি

ডা. অপূর্ব চৌধুরী

মানুষের শরীর কী দিয়ে তৈরি

শরীর দুটো জিনিস দিয়ে তৈরি। একটি জলীয়, আরেকটি জলীয় নয়। শরীরের অর্ধেক বা অর্ধেকের চেয়ে জলীয়, বাকি অর্ধেক জলীয় নয়। সঠিকভাবে শরীরের ৫০ থেকে ৭০ ভাগ জল বা জলীয় পদার্থ দিয়ে তৈরি। ধরে নেই গড়পড়তায় শরীরের ৬০ ভাগ জল, বাকি ৪০ ভাগ জল নয়। ধরুন একজন লোকের ওজন ৬০ কিলোগ্রাম। তার ৬০ ভাগ জলীয় হলে সেই শরীরে জলের পরিমাণ ৩৬ কিলোগ্রাম, জল নয় এমন পরিমাণ ২৪ কিলোগ্রাম। জলীয় পদার্থকে লিটারে প্রকাশ করে। এক কিলোগ্রাম জল ওজনে এক লিটার। তাহলে ৬০ কিলোগ্রাম ওজনের একজনের দেহে জলের পরিমাণ ৩৬ লিটার।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় শরীরে এমন জলের মোট পরিমাণকে বলে TBW  বা Total Bodz Water. এখানে একটি মজার ব্যাপার আছে। যে শরীরে যত বেশি চর্বি, তার শরীরে তত কম জল থাকে। শরীরে জলের পরিমাণ বেশি থাকা মানে চর্বির পরিমাণ কম। চর্বি বেশি থাকা মানে জলের পরিমাণ কম। একটি আরেকটির উল্টো। এ কারণে দেখা যায় পুরুষের তুলনায় নারীর শরীরে জলের পরিমাণ কম। কারণ হলো নারীর শরীরে ফ্যাট বা চর্বি বেশি থাকে, বিশেষ করে এডিপোজ টিস্যু, ঠিক এই কারণে চর্বির পরিমাণ বেড়ে গেলে শরীরে জলের মোট পরিমাণ কমে যায়। শরীরে এই চর্বির পরিমাণ শরীরের সাইজ অনুযায়ী বেশি হলেও ক্ষতি, আবার অনেক কম হলেও ক্ষতি। শরীরে এমন চর্বির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে পৃথিবীতে এখন ঘরে ঘরে ডায়াবেটিস সমস্যাটি দেখা দিয়েছে। অতিরিক্ত ফ্যাটের সঙ্গে শুধু ডায়াবেটিস নয়, গবেষণায় দেখা গেছে ক্যান্সারেরও একটি সংযোগ আছে। অতিরিক্ত ফ্যাট ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি ঘটায় দ্রুত। সমান ওজনের একজন নারী এবং একজন পুরুষের দেহে এই কারণে সমান পরিমাণ জল থাকে না। কারণ নারীর শরীরে ফ্যাট বেশি থাকার কারণে সেটি শরীরের যে জায়গা এবং ওজন দখল করে তাতে জলের অনুপাত কমে যায়। আবার ঠিক এই জল কম থাকার কারণে নারীরা এলকোহল পান করলে পুরুষের তুলনায় তাড়াতাড়ি ড্রাঙ্ক হয়ে যায়। কারণ হলো জলের পরিমাণ সমান ওজনের একজন পুরুষের চেয়ে কম থাকার কারণে সেই জলে এলকোহল তাড়াতাড়ি শোষণ হয় এবং এলকোহলের ঘনত্ব বেশি হয় পুরুষের তুলনায়। তাতে পুরুষের তুলনায় তাড়াতাড়ি মাতাল হয় নারী।

শরীরের মাত্র ০.৮% পাঁচটি মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। তাদের পরিমাণ ১% এর চেয়ে কম হলেও এই পাঁচটির সামান্য পরিবর্তন শরীরের অনেক কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। এই পাঁচটি হলো সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্লোরিন এবং সালফার
শরীরে যত মাসল আছে তার ৭৫% এই জল দিয়ে তৈরি, মস্তিষ্কের ৭০% কেবল জল, এমনকি আমাদের হাড়ের ৩০% জল দিয়ে তৈরি। ফুসফুসের আশি শতাংশই জল, চামড়ার ৬০% জল।

শরীরে সব পদার্থ, সে জল হোক, জলীয় না হোক, সব মিলে ৬১টি মৌলিক উপাদান থাকে। প্রকৃতিতে বা পৃথিবী যা দিয়ে তৈরি তাতে মোট মৌলিক পদার্থ বা এলিমেন্টস আছে ৯২টি। এই ৯২টি উপাদান দিয়ে পৃথিবী গঠিত। আর এই ৯২টির ৬১টি উপাদানই শরীরে আছে। কিন্তু শরীরের ৯৯% মাত্র ছয়টি মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। কার্বন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস। শরীরের মাত্র ০.৮% মাত্র পাঁচটি মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। তাদের পরিমাণ ১% এর চেয়ে কম হলেও এই পাঁচটির সামান্য পরিবর্তন শরীরের অনেক কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। এই পাঁচটি হলো সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্লোরিন এবং সালফার। বাকি রইল ৩০টি উপাদান। এদের সবগুলোর পরিমাণ ০.২%। এদের বলে ট্রেস এলিমেন্টস। ওজনের দিক দিয়ে এই ৩০ ধরনের ট্রেস এলিমেন্টের মোট ওজন ১০ গ্রামের কম। শরীরের এসব উপাদানের বেশিরভাগের উৎস আমাদের খাবার । তাই বলা হয়, কারও শরীর হলো সে যা খায় সেটার সমষ্টি।

মানুষের শরীরের নব্বই ভাগ মাত্র তিনটি উপাদান দিয়ে তৈরি। সবচেয়ে বেশি থাকে হাইড্রোজেন প্রায় ৬০ ভাগ, অক্সিজেন ২০ ভাগ এবং কার্বন ১০ ভাগ। আবার শরীর থেকে সব জলীয় পদার্থ বের করে নিলে যা থাকবে তার আশি শতাংশ প্রোটিন, ফ্যাট এবং কার্বোহাইড্রেট দিয়ে তৈরি।

একজন সত্তর কিলোগ্রাম ওজনের মানুষের দেহে এটম থাকে ৭-এর পাশে ২৮টি শূন্য। একে বলে সেভেন অক্টিলিওন।

শরীরে সবচেয়ে বেশি থাকে জল, প্রায় ষাট ভাগ, তারপরে সবচেয়ে বেশি থাকে প্রোটিন ২০ ভাগ এবং ফ্যাট ১০ ভাগের মতো। শরীরে সব কোষে যত DNA, RNA থাকে তাকে এক করলে শরীরের মাত্র ১% হবে।

অনেকেই মনে করে শরীরের সবচেয়ে বেশি ওজন হাড়ের। এটি ভুল। শরীরের ওজনের মাত্র ৮% হয় সবগুলো হাড় এক করলে। শরীরকে আবৃত করে রাখা চামড়াকে খুলে ওজন করলে শরীরের ওজনের মাত্র ২%। শরীরের ওজনের অর্ধেকের চেয়ে কম থাকে বিভিন্ন প্রকার পেশি বা মাংস। শরীরের ওজনের ১০% থাকে চর্বি। বয়স বাড়লে শরীরের যে ওজন বাড়ে তার বেশিরভাগ আসে এই ফ্যাট বাড়া থেকে। এই ফ্যাট বাড়লে শরীরের ওজন যেমন বাড়ে, এই ফ্যাট কমলেই শরীরের ওজন কমে যায়।

শরীরের সব জল বা জলীয় পদার্থকে শরীরের কোথায় কোথায় থাকে তার উপর ভিত্তি করে দুভাবে ভাগ করা হয়। শরীরের দুই-তৃতীয়াংশ জল থাকে শরীরের সব কোষগুলোর ভিতর। এদের বলে ICF বা Intracellular Fluid। ইন্ট্রা সেলুলার মানে কোষের ভিতর। বাকি এক-তৃতীয়াংশ জল বা জলীয় অংশ থাকে কোষের বাইরে, যাদের বলে ECF বা Extracellular Fluid। এক্সট্রা সেলুলার মানে কোষের বাইরে। আবার ECF -কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ECF -এর বেশিরভাগ জল থাকে কোষের বাইরে চারপাশে, এদের বলে Interstitial Fluid। বাকি কিছু পরিমাণ থাকে রক্তনালীর ভিতর, এদের বলে Plasma। রক্তনালীর ভিতর রক্তের যে জলীয় অংশ, সেটাই প্লাজমা এবং রক্তের কণিকা বা কোষগুলো এই প্লাজমায় ভাসতে থাকে। ECF এবং ICF পরস্পর থেকে পৃথক থাকে একটি দেয়ালের মাধ্যমে, সেল মেমব্রেন বা কোষের দেয়াল। আবার ECF-এর দুই ভাগ ইন্টারস্টিসিয়াল ফ্লুয়িড এবং প্লাজমা পরস্পর থেকে পৃথক থাকে ক্যাপিলারি ওয়াল দিয়ে ।

লেখক : চিকিৎসক ও বিজ্ঞান লেখক, লন্ডন।

[email protected]

সর্বশেষ খবর