বাংলাদেশ তুলা আমদানিতে গত পাঁচ বছরে (২০২০-২০২৪) ব্যয় করেছে প্রায় ২ হাজার ২৯ কোটি মার্কিন ডলার। বিশ্বের ৩৬টি দেশ থেকে ৩ কোটি ৯৬ লাখ বেল তুলা আমদানি করা হয়। তুলা তৈরি পোশাক খাতের প্রধান কাঁচামাল বলেই এ খাতের ওপর দেশের রপ্তানিনির্ভরতা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তুলা রপ্তানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকেই এসেছে সবচেয়ে বেশি তুলা প্রায় ২৮ লাখ ৪০ হাজার বেল, যার মূল্য ১৮৭ কোটি ডলার। এ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ব্রাজিল, চীন এবং আফ্রিকার একাধিক দেশ থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তুলা এসেছে। আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, ২০২০ সালে আমদানি হয়েছে ৩২৯ কোটি ডলারের তুলা। এ ছাড়াও ২০২১ সালে ৪৭২ কোটি ডলার, ২০২২ সালে ৫০৪ কোটি ডলার, ২০২৩ সালে ৩৩২ কোটি ডলার ও ২০২৪ সালে আমদানি হয়েছে ৩৯২ কোটি ডলারের তুলা। বিশ্ববাজারে তুলার মূল্য ওঠানামা, সরবরাহ সংকট এবং বাংলাদেশের নিজস্ব উৎপাদন কাঠামোর দুর্বলতা সব মিলিয়ে তুলার আমদানির ওপর নির্ভরতা আরও বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের তুলা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন, সহজলভ্য এবং রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল হওয়ায় এটি বাংলাদেশের জন্য অন্যতম নির্ভরযোগ্য উৎস হয়ে উঠেছে।
বিজিএমইএর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে তুলা আমাদের প্রধান কাঁচামাল। তবে কেবল আমদানির ওপর নির্ভরশীল না থেকে বিকল্প উৎস খুঁজে বের করাও এখন সময়ের দাবি। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে, যেখানে আমদানি পণ্যের অন্তত ২০ শতাংশ মূল্য ‘যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত’ উপাদান থেকে এলে তা শুল্ক ছাড় পাবে। ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারকরা এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা করছেন। উদাহরণস্বরূপ, ক্যালভিন ক্লেইনের এক জোড়া ডেনিম প্যান্ট যার ফ্রি অন বোর্ড মূল্য আট ডলার, সেখানে কাপড়ের উপাদান মূল্য ৪ দশমিক ১২৫ ডলার এবং তুলার অবদান প্রায় ৩৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত তুলা ব্যবহারে এ শুল্ক সুবিধা গ্রহণ সম্ভব।
এবিষয়ে এনভয় টেক্সটাইলের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা বছরে প্রায় ৫ কোটি ৪০ লাখ গজ ডেনিম ফ্যাব্রিক উৎপাদন করি, যার ৬০ শতাংশ রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এখন আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলার আমদানি ১৫ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছি। একইভাবে, জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফ্যাব্রিকস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল্লাহ জাবের জানান, তারা বর্তমানে ৩০ শতাংশ আমেরিকান তুলা ব্যবহার করছেন, যা ২০২৫ সালের শেষে ৫০ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশা করছেন। এ ছাড়াও বিপুল পরিমাণ তুলা আমদানি করে মতিন স্পিনিং ও হামীম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। উদ্যোক্তারা মনে করছেন, আমেরিকান তুলা তুলনামূলক ব্যয়বহুল হওয়ায় সরকারের সহায়তা প্রয়োজন।
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, আমেরিকান তুলা আমদানিতে ইডিএফ ঋণের সুদহার ২ শতাংশে নামিয়ে আনার পাশাপাশি প্রতি পাউন্ডে ৩-৪ সেন্ট হারে নগদ প্রণোদনা ও ১ শতাংশ অগ্রিম আয়ের কর (এআইটি) মওকুফ করার। বাংলাদেশ সরকার এখন একটি রোডম্যাপ তৈরি করছে, লক্ষ্য ২০২৮ সালের মধ্যে আমেরিকান তুলা আমদানির হার ২৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া। একই সঙ্গে ২০২৫ সালে আমেরিকা থেকে আমদানি করা হয় ১০০ কোটি বেল, ২০২৮ সালে তা বেড়ে হবে ২১০ কোটি বেল। দামও ৪৭ কোটি ৩৮ লাখ ডলার থেকে বেড়ে ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার পর্যন্ত হতে পারে। এ লক্ষ্যে একটি বিশেষ বন্ডেড ওয়্যারহাউস চালু করার প্রক্রিয়াও চলছে, যাতে আমেরিকান তুলা শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করা সম্ভব হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ তুলা আমদানিকারক দেশ হিসেবে অবস্থান ধরে রাখবে, যেখানে আমদানির পরিমাণ হবে ৮৫ লাখ বেল।
অন্যদিকে, চীনের তুলা আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে ২০২৪ সালে যেখানে ছিল ১ কোটি ৫০ লাখ বেল, তা ২০২৬ সালে নেমে আসবে ৭০ লাখ বেলে। এতে বাংলাদেশের তুলা আমদানির বিশ্বভিত্তিক অবস্থান আরও জোরদার হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে হলে কাঁচামাল হিসেবে আমেরিকান তুলার ব্যবহার বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। সরকারের সহায়তা, বন্ডেড সুবিধা ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ছাড়া এ লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন। তবে সঠিক সিদ্ধান্ত ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাতে বিশ্বে নেতৃত্ব আরও সুদৃঢ় করতে পারবে।