গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশ ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করেছে রাশিয়া। এরই মধ্যে পাঁচ মাস হয়েছে এই অভিযানের।
ইউক্রেনে এই যুদ্ধে হাজার হাজার ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। শত্রু পক্ষের অবস্থান জানতে, ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তে এবং শত্রুপক্ষের দিকে কামান দাগার জন্য নিশানা ঠিক করতে ড্রোন কাজে লাগানো হচ্ছে।
এই যুদ্ধে সামরিক ড্রোন যেমন ব্যবহৃত হচ্ছে (যেগুলো তৈরিই করা হয়েছে যুদ্ধের জন্য), তেমনি আবার এমন অসামরিক ড্রোনও ব্যবহার করা হচ্ছে যা দোকানে কিনতে পাওয়া যায়।
ইউক্রেন এবং রাশিয়ার কার কেমন ড্রোন আছে?
ইউক্রেনের ব্যবহৃত প্রধান সামরিক ড্রোন তুরস্কের তৈরি, এটির নাম বেরাকতার-টিবি২। আকারে এটি একটি ছোট উড়োজাহাজের সমান।
এতে ক্যামেরা লাগানো আছে এবং লেজার-নিয়ন্ত্রিত বোমাও বহন করা যায়।
যুক্তরাজ্যের গবেষণা সংস্থা রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউটের (রুসি) গবেষক জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন, যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন ইউক্রেনের কাছে এরকম ৫০টিরও কম ড্রোন ছিল।
অন্যদিকে রাশিয়া মূলত ব্যবহার করে ছোট-খাট সাধারণ মানের ওরলান-টেন ড্রোন।
জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, যুদ্ধের শুরুতে রাশিয়ার কাছে এরকম হাজারও ড্রোন ছিল। এখন হয়তো আর কয়েকশ’ অবশিষ্ট আছে। এই ড্রোনেও ক্যামেরা আছে এবং এটি থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া যায়।
সামরিক ড্রোন কতটা কার্যকরী?
শত্রুপক্ষের টার্গেট খুঁজে বের করা এবং সেখানে নিশানা করে কামানের গোলা ছোঁড়ার ক্ষেত্রে দু’পক্ষের ড্রোনই বেশ কার্যকরী।
জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, “ওরলান-টেন যখন শত্রুপক্ষের কোনও টার্গেট খুঁজে পায়, তখন রুশরা তিন হতে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তাদের কামান সেদিকে তাক করে গোলা দাগাতে পারে।”
তিনি বলেন, এই ড্রোনের সাহায্য না পেলে রুশদের এরকম একটা হামলা চালাতে ২০ হতে ৩০ মিনিট সময় লাগতো।
লন্ডনের কিংস কলেজের ডিফেন্স স্টাডিজের একজন গবেষক ড. মার্টিনা মিরন বলেন, ড্রোনের সাহায্য নিয়ে ইউক্রেনিয়ানরাও তাদের সীমিত বাহিনীর সক্ষমতা অনেকখানি বাড়াতে পেরেছে।
তিনি বলেন, “অতীতে আপনাকে যদি শত্রুবাহিনীর অবস্থানে গিয়ে হামলা করতে হতো, তার একমাত্র উপায় ছিল সেখানে স্পেশাল কমান্ডো বাহিনী পাঠানো এবং এভাবে হামলা চালাতে গিয়ে হয়তো বেশ কিছু সৈন্য মারা পড়তো।”
“কিন্তু এখন কেবল একটা ড্রোনের ওপর ঝুঁকি নিয়েই কাজটা করা হচ্ছে।”
যুদ্ধের প্রথম কয়েক সপ্তাহে ইউক্রেন বেরাকতার-টিবি২ ড্রোন দিয়ে সফল কিছু হামলা চালিয়ে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে।
ডঃ মিরন বলেন, “অস্ত্রের গুদামের মতো লক্ষ্যবস্তু খুঁজে বের করা এবং রাশিয়ার মস্কভা যুদ্ধজাহাজে হামলা চালিয়ে সেটিকে ডুবিয়ে দিতে এই ড্রোন ভূমিকা রাখে।”
তবে ইউক্রেনের অনেক বেরাকতার ড্রোন রাশিয়ার হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে।
“এগুলো বেশ বড় এবং তুলনামূলকভাবে ধীর গতিতে চলে, আর এগুলো ওড়ে মাঝারি উচ্চতায়, ফলে গুলি করে এই ড্রোন ফেলে দেওয়া বেশ সহজ”, বলছেন ড. ওয়াটলিং।
অসামরিক ড্রোন কিভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে?
সামরিক ড্রোনের দাম অনেক বেশি, কাজেই ধ্বংস হলে নতুন করে পাওয়া সহজ নয়। কেবল একটি বেরাকতার-টিবি২ ড্রোনের দাম ২০ লাখ ডলার।
কাজেই দু’পক্ষই- বিশেষ করে ইউক্রেন- এখন ছোট বাণিজ্যিক মডেল ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। এরকম একটি ড্রোন হচ্ছে ডিজেআই ম্যাভিক-৩, যেটির দাম পড়ে ১ হাজার ৭শ ডলার।
ইউক্রেনের ড্রোন প্রস্তুতকারী একটি কোম্পানির হিসাব অনুযায়ী দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনীর হাতে হয়তো ৬ হাজারের মতো ড্রোন আছে, তবে এই তথ্য যাচাই করা কঠিন।
বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত ড্রোনেও ছোট আকারের বোমা লাগানো যায়। তবে এগুলো মূলত ব্যবহৃত হয় শত্রু বাহিনীর অবস্থান জানা এবং সেখানে হামলায় সাহায্য করার কাজে।
ড. মিরন বলেন, “রাশিয়ার মতো অত সমরাস্ত্র ইউক্রেনের নেই। কাজেই যদি নজরদারির জন্য আকাশে একটা চোখ থাকে, যা দিয়ে টার্গেট খুঁজে বের করা যায় এবং তারপর সেখানে কামানের গোলা দাগাতে নিশানা ঠিক করা যায়, তাহলে ইউক্রেনিয়ানরা তাদের যে অস্ত্র আছে সেগুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারে।”
তবে বাণিজ্যিক ড্রোনগুলো সামরিক ড্রোনের তুলনায় কম শক্তিশালী। যেমন ডিজেআই ম্যাভিকের পাল্লা মাত্র ৩০ কিলোমিটার আর এটি উড়তে পারে মাত্র ৪৬ মিনিট।
আরও ছোট এবং সস্তা যেসব ড্রোন কিনতে পাওয়া যায়, সেগুলো উড়তে পারে আরও কম সময় এবং যেতে পারে আরও কম দূরত্ব।
ড্রোন হামলা থেকে বাঁচতে কোন পক্ষ কী করছে?
রাশিয়া সামরিক ড্রোনের হামলা ঠেকাতে তাদের রাডার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে। আর বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত ড্রোন ঠেকাতে ব্যবহার করে ইলেকট্রনিক যন্ত্র, বলছেন ড. মিরন।
তিনি বলেন, “রুশ বাহিনীর হাতে আছে স্টুপার রাইফেল, এটি থেকে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালস নিক্ষেপ করা যায়। বাণিজ্যিক ড্রোন যেন জিপিএস ব্যবহার করে পথ খুঁজে না পায়, সেটা থামানো যায় এটা দিয়ে।”
বাণিজ্যিক ড্রোনের সঙ্গে যেন এর অপারেটরের যোগাযোগে বাধা সৃষ্টি করা যায়, সেজন্যে রুশ বাহিনী এরোস্কোপের মতো অনলাইন সিস্টেমও ব্যবহার করে।
এটি দিয়ে ড্রোনটিকে মাটিতে ফেলে দেওয়া যায় বা ঘাঁটিতে ফেরত পাঠানো যায়- কিংবা একদম যাতে তথ্য পাঠাতে না পারে, সেরকম প্রতিবন্ধকতাও তৈরি করা যায়।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউটের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, একটি গড়পড়তা ইউক্রেনিয়ান ড্রোন বড়জোর এক সপ্তাহ টিকে থাকতে পারে।
কে ড্রোন সরবরাহ করছে
যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা, রাশিয়া এখন ইরানের কাছ থেকে শাহিদ সামরিক ড্রোন কিনছে। ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে হামলা চালানোর জন্য এসব ড্রোন ব্যবহার করে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে প্রায় সাতশ’টি সুইচব্লেড ‘কামিকাজে’ সামরিক ড্রোন দিয়েছে।
এই ড্রোনের ভেতর বিস্ফোরক বোঝাই করা থাকে। এগুলো লক্ষ্যবস্তু খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আকাশে চক্কর দিতে থাকে।
ইলন মাস্কের কোম্পানি স্পেসএক্স ইউক্রেনকে স্টারলিংক স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবস্থা সরবরাহ করছে। এটির মাধ্যমে বাণিজ্যিক ড্রোন এবং এর অপারেটরের মধ্যে একটি গোপন এবং নিরাপদ সংযোগ তৈরি করা যায়।
তবে ডিজেআই এখন রাশিয়া এবং ইউক্রেন- উভয়ের কাছেই ড্রোন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।
ইউক্রেন কীভাবে ড্রোন কেনার অর্থ পাচ্ছে
ইউক্রেন ২০০ সামরিক ড্রোন কিনতে ক্রাউডফান্ডিংয়ে একটি আবেদনের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করছে।
ডঃ ওয়াটলিং বলেন, “বেরাকতার-টিবি২ ড্রোনের মত বড় সামরিক ড্রোন ছাড়াও তারা ছোট নজরদারি ড্রোন সংগ্রহেরও চেষ্টা করছে।”
এবার ইউরোভিশন সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় জয়ী কালুশ অর্কেস্ট্রা তাদের ট্রফি নয় লাখ ডলারে বিক্রি করে দিয়েছিল। তারা এই অর্থ ইউক্রেনের ড্রোন কেনার তহবিলে দান করেছে। এই অর্থ দিয়ে ইউক্রেনে তৈরি তিনটি পিডি-টু ড্রোন কেনা যাবে। সূত্র: বিবিসি বাংলা
বিডি প্রতিদিন/কালাম