১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা অনেকের মনে আছে নিশ্চয়ই। সেদিন খারাপ নির্বাচনের একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ তৈরি হয়েছিল। তবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জমানায় তার চেয়েও বহু গুণে বেশি বাজে ইলেকশন হয়েছে। এরশাদের ইলেকশনে জণগণের অংশগ্রহণ না থাকলেও ভোট পড়েছিল সাড়ে ৫২ শতাংশ। আগের রাতে প্রিসাইডিং অফিসাররা পোলিং অফিসার ও এজেন্টদের সঙ্গে নিয়ে ভোট কেটে বাক্স বোঝাই করে রাখতেন। প্রথম মেয়াদের শেষে এসে বিএনপি সরকারকেও প্রায় ওই রকমই ভোটারবিহীন একটা ইলেকশন করতে হয়েছিল। সেই ভোটটি হয়েছিল ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি। লোকদেখানো ভোটে সাধারণ মানুষের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। কুড়িয়ে বাড়িয়ে ভোট পড়েছিল মাত্র ২১ শতাংশ। তবে ভোটে কোনো জালিয়াতি হয়নি। জাল ভোট যদি দেওয়া হতো তাহলে আরও অনেক বেশি ভোট পড়তে পারত।
পর্যবেক্ষক মহলের অনেকেই বলেন, দাবার কোটে চালে ভুল করে জাতীয়তাবাদী সরকারকে ওই রকম অস্বাভাবিক একটা ইলেকশন করতে হয়েছিল। কারণ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং যুগপতের সাথি জামায়াতে ইসলামী মিলে বেগম জিয়ার সরকারের জন্য বেকায়দা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। সরকারেরও কিছু একগুঁয়েমি ছিল। তবে শেষ ভালো যার সব ভালো তার। সেই ইলেকশনের মাধ্যমে গঠিত পার্লামেন্ট গণতন্ত্রের পথে পালন করেছিল এক ঐতিহাসিক ভূমিকা। সংসদের প্রথম অধিবেশনেই গৃহীত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন। তার কিছুদিন পরেই ৩০ মার্চ ১৯৯৬ সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। বেগম জিয়া ক্ষমতা থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ান।
গঠিত হয় বিচারপতি হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কেয়ারটেকার সরকার, যেটি ছিল পুরোপুরি সংবিধানসম্মত। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের যে সরকার হয়েছিল সেটা গঠনের সময়ে সংবিধানসম্মত ছিল না। পরে পঞ্চম সংসদে সেই সরকারের বৈধতা স্বীকার করে নেওয়া হয় সর্বসম্মতভাবে। কাজেই ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক বা কেয়ারটেকার সরকারের যে বিধান করা হয়, যে কোনো বিচারে তা ইতিহাসের একটি মহৎ দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃত হতে পারে।
অতীতের সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে বিএনপিকে অবশ্যই শিক্ষা নিতে হবে। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় দল নিঃসন্দেহে বিএনপি। তার সামনের আজকের চ্যালেঞ্জগুলোও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। জুলাই অভ্যুত্থানের পর জাতীয়তাবাদী এ দলটির পথ যতটা প্রশস্ত হয়েছে বলে মনে করেছিল, বাস্তবে মোটেও তা নয়। সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেগুলো বিএনপির সঙ্গে মিলে ১৫ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে তাদের অনেকে এখন আর আগের অবস্থানে নেই। কোনো কোনোটি কোনো কোনো প্রশ্নে বিএনপির বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করেছে। ছাত্রদের দল এনসিপি বিএনপিকে এরই মধ্যে প্রতিপক্ষ বানিয়ে নিয়েছে, যদিও দলটি এখন পর্যন্ত কোনো সুসংগঠিত পার্টি হয়ে উঠতে পারেনি।
ধারে না কাটলেও এনসিপি ভারে কম কাটছে না। এত ওজন এ নবীন পার্টির কেমন করে হলো সে এক জটিল সমীকরণ। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের সঙ্গে এনসিপির কী সম্পর্ক তা ওপেন সিক্রেট। ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণা করে ইলেকশন ট্রাইব্যুনাল রায় দেওয়ার পর এনসিপির বিএনপিবিরোধী অবস্থান প্রকট হয়ে উঠেছে। নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের রায় তারা মানতে নারাজ। এনসিপি এখন খোদ নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। দলের একজন এমনও বলেছেন যে নির্বাচন কমিশনের অফিস এখন বিএনপির অফিস হয়ে গেছে। নাগরিক পার্টি এ নির্বাচন কমিশন ভেঙে দিয়ে নতুন কমিশন গঠনের দাবি তুলেছে। তারা বলছে এ কমিশন পুনর্গঠন করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিতে হবে সবার আগে। দলটি গণপরিষদের ইলেকশনও দাবি করেছে। ট্রাইব্যুনালের রায় মানতে এনসিপির না-রাজি আর ইশরাক হোসেনকে করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়া- এ দুইয়ের মধ্যেকার যোগসূত্র লোকের বুঝতে না পারার কোনো কারণ নেই। এ বাস্তবতায় ভারে কাটা নতুন দলটিকে বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেওয়া অত সহজ নয়। অন্যদিকে পুরোনো মিত্র জামায়াতে ইসলামী বিএনপির বিপক্ষে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে মরিয়া। কোনো কোনো জায়গায় সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত নীতিকৌশলের বেশির ভাগই বিএনপি সমর্থন করতে পারছে না। পদে পদে বিরোধ তৈরি হচ্ছে। সংস্কার কমিশনগুলো যেসব সুপারিশ করেছে তার খুব কমসংখ্যকই বিএনপি সমর্থন করছে। যেসব বিষয়ে দলটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে সহমত প্রকাশ করেছে, সেগুলোও কবে-কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তা নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যে সংসদ হবে এবং যে সরকার আসবে তারা সংস্কার করবে। সংস্কার করা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ না। এ অবস্থান বিএনপির। জাতীয়তাবাদী দল ডিসেম্বরে কিংবা তার আগেই ইলেকশন চাইছে। বিএনপির এ অবস্থানের সঙ্গে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের মিল রয়েছে। সেনাপ্রধানও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হোক- এমনটাই প্রত্যাশা করেন। একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের অপেক্ষায় রয়েছেন বলে গত বুধবার ঢাকা সেনানিবাসে সেনা কর্মকর্তাদের বৈঠকে সেনাপ্রধান এ মনোভাব প্রকাশ করেন। তাঁর মতে রাখাইন রাজ্যের জন্য করিডর দেওয়া, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার এ সরকারের নেই। বিষয়টিকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত নয়।
পক্ষান্তরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান পূর্বাপর বলে চলেছেন যে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনটি নাকি হবে উৎকৃষ্ট নির্বাচনের এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। কার্যক্ষেত্রে ডিসেম্বরে ইলেকশন হবে এমন কোনো আলামত নেই। এনসিপির দাবি অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, স্থানীয় সরকার ও গণপরিষদ নির্বাচন করার পরে যদি জেনারেল ইলেকশন করতে হয়, তাহলে সহসা নির্বাচিত সরকার গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিএনপি বলছে সামনের জুন পর্যন্ত তারা নির্বাচনের রোডম্যাপের জন্য অপেক্ষা করবে। তারপরই শুরু হবে আন্দোলন। দেশব্যাপী বিএনপির একার পক্ষে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা এখন কতটা সম্ভব, তা-ও দেখতে হবে। আগেই বলেছি, পুরোনো মিত্র জামায়াতে ইসলামী বিএনপির সঙ্গে নেই। ইউটার্ন নিয়েছে। এ পরিস্থিতি বিএনপিকে মোকাবিলা করতে হবে খুব সাবধানে।
বিএনপি অনেক বড় দল হলেও ১৭ বছরে দলের সাংগঠনিক টাইটনেস অনেকটাই আলগা হয়ে গেছে। দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনা অনেক ক্ষেত্রে ঠিকমতো কাজ করছে না। গ্রাম-মফস্বলের একশ্রেণির নেতা-কর্মী ৫ আগস্টের পর ধরাকে সরাজ্ঞান করতে শুরু করেছেন। তাদের ভাবখানা এমন; যেন তাদের দল সরকারে চলেই গিয়েছে। চাঁদাবাজি, দখলবাজিতে তাদের অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বলে নানা সূত্রে পাওয়া খবরে প্রতীয়মান হয়। স্কুল-কলেজ, মসজিদ ও মাদরাসার কমিটি, বালুমহাল, সেতুর টোল, টেন্ডার-ফেন্ডার সব তাদের চাই। স্থানীয় প্রশাসনকে চলতে হবে তাদের কথায়। মাঠপর্যায়ে এসব অপকর্ম যে কেবল বিএনপির একশ্রেণির নেতা-কর্মীই করছেন তা কিন্তু নয়। অনেক ক্ষেত্রে বিএনপিকে সামনে দিয়ে অন্যান্য দলের লোকেরা নাকি মিলেমিশেই কর্মসাধন করছে। বিএনপিকে পচাতে কৌশল হিসেবে এটা মন্দ নয়। তবে এ-ও ঠিক যে বিএনপির ইমেজ ক্লিন রাখার দায়িত্ব অন্য কোনো দলের নয়। এ দায়িত্ব জাতীয়তাবাদী দলের নিজের।
দলের ইমেজ নষ্ট করে এমন কাজ থেকে নেতা-কর্মীদের বিরত থাকতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বহুবার বহুভাবে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। অনেকের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়াও হয়েছে। তাতে ফলোদয় হয়েছে সামান্য। পত্রিকায় প্রতিদিনই বিএনপির একশ্রেণির নেতা-কর্মীর তাফালিংয়ের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। তার কিছু সত্য, কিছু হয়তো ফেব্রিকেটেড। কিন্তু সব খবর অসত্য নয়। মনে রাখা দরকার, ভোটের রাজনীতিতে বুদ্ধিমান লোকের খুব দরকার থাকলেও দুষ্ট লোকের বিশেষ প্রয়োজন নেই। পেশিশক্তি দিয়ে ভোটের বাক্স ছিনিয়ে নেওয়া যায়, জালিয়াতি করা যায়, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা দেওয়া যায়, কিন্তু ভোটারের মন জয় করা যায় না। ফেয়ার ভোটে জিততে হলে ভোটারের মন জয় করতে হবে।
অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় নেটিজেন ও বিদেশে অবস্থানরত গালিগালাজ চ্যাম্পিয়ন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের অনেকে এখন বিএনপির বিপক্ষে চলে গেছে। নেটিজেনদের অনেকের হিরো হয়ে বসে আছে এ অ্যাক্টিভিস্টরা। সামাজিক মাধ্যমে শত শত কমেন্ট ও পোস্ট দেখা যায়, যেখানে বিএনপির বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা বলা হচ্ছে, বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে জাতীয়তাবাদী দলের কর্মী-সমর্থকরা সামাজিক মাধ্যমে কনটেস্ট করছেন না। প্রতিবাদ করছেন না। সোজা কথায় ইনঅ্যাকটিভ। লোকে বলে তারা অ্যাকটিভ ধান্ধাবাজিতে। বর্তমানে জনমনে সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব অনস্বীকার্য। বলাই বাহুল্য সামাজিক মাধ্যমও দলটির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে বলেই মনে হয়। কেউ কেউ দেশের অরাজক পরিস্থিতিতে ওয়ান-ইলেভেনের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা করছেন। একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপির এদিকটাতেও খেয়াল রাখা দরকার। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে জাতীয়তাবাদী দলকে আরও সতর্ক হতে হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক