৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১১:১৫
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন

ব্রিটিশ পাউন্ডের দরে রেকর্ড ধসের পেছনে যাকে দায়ী করা হচ্ছে

অনলাইন ডেস্ক

ব্রিটিশ পাউন্ডের দরে রেকর্ড ধসের পেছনে যাকে দায়ী করা হচ্ছে

কোয়াসি কোয়ার্টেং। ছবি: সংগৃহীত

চলতি সপ্তাহে মার্কিন ডলারের বিপরীতে ব্রিটিশ পাউন্ডের দর সর্বনিন্মে নেমে গেছে। ইউকে বন্ড বিক্রয়ে ব্যাপক ধস নামায় এই পরিস্থিতিতে পড়েছে ব্রিটিশ পাউন্ড। আর এ জন্য কেবল একজন ব্যক্তিকেই দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। তিনি হলেন- ব্রিটেনের নতুন অর্থমন্ত্রী কোয়াসি কোয়ার্টেং। কেননা, সম্প্রতি তিনি কর কমানোর ঘোষণা দেওয়ার পরই ব্রিটিশ পাউন্ডের দরে ধস নামে। তবে ব্রিটেন স্ব-প্ররোচিত অর্থনৈতিক এই বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজছে।

প্রায় এক মাস হল ব্রিটেনের শীর্ষ অর্থনৈতিক পদ- চ্যান্সেলর অব এক্সচেকার তথা অর্থমন্ত্রীর পদে আসীন হয়েছেন ৪৭ বছর বয়সী কোয়াসি কোয়ার্টেং। তিনি কোনওভাবেই অনভিজ্ঞ নন। ২০১০ সালে সংসদ সদস্য হওয়ার আগে, তিনি বিনিয়োগ ব্যাংক এবং হেজ ফান্ডে কাজ করেন। তিনি কেমব্রিজের ইটন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং হার্ভার্ডে কেনেডি স্কলার ছিলেন। তিনি একজন প্রশিক্ষিত অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ। তিনি অর্থনীতির ওপর বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন, যেগুলো ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে এবং এসব বইয়ের জন্য বহু অনুদানও পেয়েছেন।

ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরে দেশটির অর্থনীতির এই ধসের জন্য এই অর্থনীতিবিদ দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।

শুক্রবার কোয়াসি কোয়ার্টেং একটি ‘মিনি বাজেট’ ঘোষণা করেন। এতে দেড় লাখ পাউন্ডের বেশি আয় করা নাগরিকদের জন্য ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত আয়কর বাতিল এবং ব্যাংকারদের বোনাসের উপর ‘ক্যাপ’ বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হয়।

এই পদক্ষেপগুলো যে নাটকীয়ভাবে সরকারের রাজস্ব হ্রাস করবে তা অনুমিতই ছিল। একই সময়ে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট ভোক্তাদের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ বিল থেকে পরিত্রাণ দিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার পরিকল্পনাও করেছে লিজ ট্রাস সরকার। এর অর্থ হল- যখন সব কিছুর দাম দ্রুত বাড়ছে, তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে বড় অংকের অর্থ ধার করছে সরকার। এই বিষয়গুলো একসঙ্গে মেলানো যায় না তা বুঝতে বা দেখতে কেমব্রিজের পিএইচডি লাগে না।

বাজারের প্রতিক্রিয়া কী?

বাজারে বর্তমানে আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত সোমবার প্রতি পাউন্ডের দর ছিল ১.০৩ মার্কিন ডলারের সমান, যা বিগত ছয় মাস আগের থেকে ২২ শতাংশ কম। সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় ইতোমধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে, যাকে যুক্তরাজ্য ‘কস্ট অব লিভিং ক্রাইসিস’ বলে থাকে। এর দুই দিন পর, ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ব্রিটেনের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে মরিয়া প্রয়াস চালায় এবং জরুরি ভিত্তিতে বিপুল পরিমাণ বন্ড কিনে নেয়।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সাধারণত টিনপট একনায়কত্ব এবং বানানা রিপাবলিকের মতো দেশগুলোকে এই ধরনের পদক্ষেপে তিরস্কারের মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করে।

মঙ্গলবার প্রকাশিত গভীর সমালোচনামূলক নোটে জাতিসংঘ-সমর্থিত তহবিল আইএমএফ বলেছে, “ব্রিটেনের এসব পদক্ষেপে দেশটিতে বৈষম্য বাড়াতে পারে।”

ব্রিটেনের এই ‘মিনি বাজেট’- ব্রিটিশ অর্থনৈতিক স্কেলের জন্য ব্রেক্সিট, মহামারী এবং ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়েও বড় বিপর্যয় বলে মনে হচ্ছে। তাহলে লিজ ট্রাস সরকার কেন এমন করল?

বিশ্লেষকরা মাথা চুলাচ্ছিলেন, বিশেষ করে যখন ট্রাস সরকার বাজেটের জন্য ‘অফিস ফর বাজেট রেসপন্সিবিলিটি’র মতো বিষয়টি মূল্যায়ন করার প্রয়োজনীয়তা লঙ্ঘন করে।

অনেকেই মনে করেন- অর্থনীতি বিষয়ে কোয়ার্টেংর লেখায় এমন কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা চরম মুক্ত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিতর্কিত- বলা যায় মৌলবাদী মতবাদ বা দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল- কোয়ার্টেং, ট্রাস ও অন্যান্য কনজারভেটিভ এমপি কর্তৃক  ২০১২ সালে প্রকাশিত একটি বই, যার নাম ‘ব্রিটানিয়া আনচেইন্ড’। বইটি যুক্তি দেখায় যে- ব্রিটেন ‘উচ্চ ট্যাক্স’ এবং ‘অত্যধিক আইন’ দ্বারা একটি ‘স্ফীত রাষ্ট্র’ হয়ে উঠেছে। কেবলমাত্র আক্রমণাত্মক প্রো-মার্কেট, স্বাধীনতাবাদী অবস্থান দেশটিকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে পৌঁছে দিতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, দ্রুত বর্ধনশীল এশীয় অর্থনীতির তুলনায় যুক্তরাজ্যকে চরম দুর্দশাগ্রস্ত দেখাচ্ছে।

বইটিতে আরও বলা হয়, “ভারতীয় শিশুরা ডাক্তার বা ব্যবসায়ী হতে চায়, ব্রিটিশরা ফুটবল এবং পপ সঙ্গীতে বেশি আগ্রহী।”

ক্রেডিট সংকট ও অর্থনৈতিক পতন এড়াতে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের পদক্ষেপ

সেই সময়, ব্রিটানিয়া আনচেইনড’ এর লেখকদের এই নামের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’ চলতি সপ্তাহে উল্লেখ করেছে, অর্থনৈতিক ইতিহাসের উপর কোয়ার্টেংয়ের অন্যান্য কাজ আর্থিক বাজার এবং ব্যাংকারদের একটি বর্ধিত অবিশ্বাসকেই তুলে ধরে, যা নতুন করে আবারও প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে।

তার ডক্টরাল থিসিস- যা উইলিয়াম তৃতীয়-এর সিদ্ধান্তের শিরোনাম-দখলকারী বিষয়ের চেয়ে কম আলোকপাত করে। ১৬৯৫-৯৬ সালে ইংল্যান্ডের মুদ্রা পুনরায় জারি করার দিকে মনোনিবেশ করেন- যুক্তি দিয়েছিলেন যে ‘স্বর্ণকার এবং ব্যাংকারদের স্বার্থ জাতির সাধারণ কল্যাণের জন্য ক্ষতিকারক নয়।

যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে কিছু সংস্কার দরকার, এর কথার বিরুদ্ধে খুব কম মানুষই যুক্তি-তর্ক করবে। ১৪ বছর আগের আর্থিক বিপর্যয়ের পর থেকে অর্থনীতির শ্লথ হয়ে গেছে। এরপর থেকে গড় বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ১ শতাংশ, যা ১৯৪৮ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যবর্তী বছরগুলোতে ছিল ২.৭ শতাংশ।

কোয়ার্টেংয়ের মিনি-বাজেট অর্থনীতিতে যুক্তরাজ্যের জন্য সাপ্লাই-সাইড অর্থনৈতিক শক থেরাপি বলেই মনে হচ্ছে। 

এই অনুপ্রেরণা হয়তো আমেরিকা থেকে এসেছে। বিশেষ করে ব্রিটিশ চ্যান্সেলর মার্গারেট থ্যাচারের আদর্শ- মার্কিন সমকক্ষ রাষ্ট্রপতি রেগান, যাকে ‘সরকারি রাজস্ব ও সরকারি সম্পদ কমানোর জন্য ‘স্টার্ভ দ্য বিস্ট’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়।’

কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম টুজ এই সপ্তাহে গার্ডিয়ানের জন্য লিখেছিলেন, বাজারের বিশৃঙ্খলা তাত্ত্বিকভাবে এই ধারণাটিকে উপকৃত করতে পারে: “কর কমানো এবং রাজস্ব কমে যাওয়ার সাথে সাথে সরকার ব্যয় কমানোর জন্য অপ্রতিরোধ্য চাপ তৈরি করবে। যখন আপনি আর্থিক বাজার থেকে চাপ নিতে পারবেন তখন যুক্তিটি আরও জরুরি।”

কিন্তু ব্রিটেন আমেরিকা নয়। "Reaganomics" শুধুমাত্র বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনীতিই নয়, এর প্রধান মুদ্রা, শক্তিশালী মার্কিন ডলার দ্বারাও সমর্থিত ছিল।

ট্রাস এবং কোয়ার্টেং নেতৃত্ব ব্রিটেনের তাও নেই। এর কিছু প্রবল সমর্থক এখনও স্বীকার করতে পারেনি যে ব্রিটেন একটি ক্ষয়প্রাপ্ত শক্তি, যা অর্থনৈতিকভাবে ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে- কারণ এর প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়ছে।

দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমসের জনান গণেশ চলতি সপ্তাহে লিখেছেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রিটেন যা করেছে তার অনেক কিছু থেকেই বোঝা যায় যে- এটি ৩৩০ মিলিয়ন জনগণের একটি দেশ এবং এর বার্ষিক উৎপাদন ২০ ট্রিলিয়ন ডলারের।

মিনি-বাজেটের প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় নিয়ে- বাজারগুলোতে শুধু বন্ড বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংকাররা মনে করছেন না যে, কর কমানোর মতো বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রবৃদ্ধি বাড়াবে। সত্যিকার অর্থেই অনেকে হতবাক হয়েছেন যে, অর্থনীতির সমস্যা বিবেচনায় নয়, শুধুমাত্র ঘাটতি কমানো ও রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাজ্য সরকার অর্থনীতির এই দুর্যোগকালে এমন সিদ্ধান্ত নেবে।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধে জেপি মরগান লিখেছেন, “যদিও এই প্যাকেজটি খবু একটা বড় নয়। কিন্তু সরকার এর প্রভাবকে কিছু মনেই করছে না। একই সঙ্গে এটি এমন বিতর্কিত কৌশলকে স্বাগত জানাচ্ছে যা অর্থোডক্সির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।”

কোয়ার্টেং ও তার সহযোগীরা বাজারের প্রতিক্রিয়া দেখে বিস্মিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু তারা ব্যাংকারদের আশ্বস্ত করার জন্য প্রকাশ্যে খুব কম মন্তব্য করছেন। কর কমানোর প্রভাবের উপর তাকে খুব বেশি মনোযোগী বা খুব রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বলেও মনে হচ্ছে না- নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন এমপি ‘দ্য ইকোনমিস্টকে’ এসব কথা বলেন।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের রাজনীতির অধ্যাপক টনি ট্র্যাভার্স ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, “তারা অজনপ্রিয়তার এই ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক। কারণ তারা মনে করে এটি দীর্ঘমেয়াদে কাজ করবে।”

যদি এটি শেষ পর্যন্ত কাজ করে, তবে বেশিরভাগ প্রশংসা সম্ভবত ট্রাসের পরিবর্তে কোয়ার্টেংয়ে ঝুলিতে যাবে, যার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সময়ের সাথে সাথে উল্লেখযোগ্যভাবে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে হয়। কোয়ার্টেংকে একজন সত্যিকারের সাপ্লাই-সাইড ইকোনমিস্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যাকে অন্য একজন এমপির স্ত্রী ‘প্রয়োজনীয়ভাবে একাডেমিক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ঘানার অভিবাসীপুত্র কোয়ার্টেংই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি, যিনি যুক্তরাজ্যের ‘চ্যান্সেলর অব এক্সচেকার’ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।

কিন্তু যদি এই কৌশল কাজ না করে? ইতোমধ্যেই জল্পনা শুরু হয়ে গেছে যে, পরবর্তী নির্বাচনের আগেই পতন ঘটবে লিজ ট্রাস সরকারের। নিয়ম অনুযায়ী, আগামী ২০২৫ সালের জানুয়ারির আগেই পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা। আর এর অর্থ হবে এক দশক বা তারও কম সময়ে পঞ্চম ব্রিটিশ নেতা হিসেবে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি হবেন লিজ ট্রাস।

আর চ্যান্সেলর অব এক্সচেকার তথা অর্থমন্ত্রী হিসেবে কোয়ার্টেং ইতিহাসের বইয়ে স্থান করে নেবেন, যিনি প্রমাণ করবেন যে তার নিজস্ব মতাদর্শ কাজ করেনি। সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট

বিডি প্রতিদিন/কালাম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর