আটলান্টিক মহাসাগরে বিশ্বের সবচেয়ে দামি ও উন্নত পরমাণু চালিত যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চীন-তাইওয়ান উত্তেজনার মধ্যেই এই সিদ্ধান্ত নিল আমেরিকা।
‘ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড’ নামের এই যুদ্ধজাহাজ আটলান্টিক মহাসাগরে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘ন্যাটো’র ‘স্ট্রাইক কোরের’ অংশ হিসেবে কাজ করবে।
জানা গেছে, মঙ্গলবার থেকেই ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে টহল শুরু করেছে। ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপের প্রধান জাহাজ এটি। এর সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ, ন্যাটো দেশগুলোর ছয়টি জাহাজ এবং একটি সাবমেরিন রয়েছে।কী আছে ‘ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড’ যুদ্ধজাহাজে?
১,৩০০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই যুদ্ধজাহাজটি আমেরিকার ৩৮তম প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের নামাঙ্কিত। ১৯৭৪-৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট পদে থাকা প্রয়াত ফোর্ড মার্কিন নৌসেনার সাবেক এই কর্মকর্তা।
৩৩৭ মিটার দীর্ঘ এবং এক লাখ টন ওজনের এই যুদ্ধজাহাজে ৭৫টিরও বেশি যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টার রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। বিমানবাহী রণতরীটির ফ্লাইট ডেকের প্রস্থ প্রায় ৭৮ মিটার। তাতে রয়েছে দু’টি রানওয়ে।
২০০৫ সালের আগস্ট এই যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ নিয়ে আলোচনা এবং নকশা তৈরি শুরু হয়। নিউপোর্ট নিউজ শিপবিল্ডিং কোম্পানিকে দেওয়া হয় ফোর্ড গোত্রের প্রথম বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের টেন্ডার।
২০০৯-এর গোড়ায় শুরু হওয়ার পরে চার বছরেরও বেশি সময় ধরে চলেছিল ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড নির্মাণের কাজ। ২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম পানিতে ভাসে বিশালাকৃতির এই যুদ্ধজাহাজ।
দীর্ঘ ‘সি ট্রায়াল’ পর্বের পরে ২০১৫ সালে ফোর্ডে অস্ত্রসম্ভার বসানোর কাজ শেষ হয়। ২০১৭ সালের অক্টোবরে এই যুদ্ধজাহাজকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকার নৌবাহিনীর হাতে তুলে দেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
পঞ্চাশের দশকে তৈরি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ ২০১২ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন নৌবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছিল। ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ডকে সেই ‘শূন্যস্থান’ পূরণে কাজে লাগানো হয়।
আমেরিকার দ্বিতীয় নৌবহরের প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল ড্যান ডোয়ার জানিয়েছেন, পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে ভূমিকা বদলেছে ফোর্ডের। ন্যাটোর জোটের নৌবাহিনী ‘ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপে’ আটলান্টিকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলাবে এই যুদ্ধজাহাজ।
দু’টি পরমাণু চুল্লিবিশিষ্ট এই যুদ্ধজাহাজ বেশ কয়েক বছর ধরে টানা সমুদ্রে থাকতে পারে। ওই সময়ের মধ্যে জ্বালানির জন্য কোনও বন্দরে ভিড়তে হবে না ফোর্ডকে। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি বড় সুবিধা।
এক লাখ টন ওজন নিয়েও ঘণ্টায় ৩০ নটিক্যাল মাইল (৫৬ কিলোমিটার) গতিবেগে ছুটতে পারে ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড। এতে থাকতে পারেন ৯,০০০-এরও বেশি নৌসেনা এবং অন্যান্য কর্মী।
আমেরিকা ছাড়াও এই যুদ্ধজাহাজে ন্যাটো-ভুক্ত দেশ কানাডা, ফিনল্যান্ডে, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস এবং স্পেনের নৌসেনারা ঠাঁই পাবেন। বস্তুত, আটলান্টিক মহাসাগরে ন্যাটোর ‘ভাসমান দুর্গের’ ভুমিকা পালন করবে ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড।
তবেআটলান্টিকে মোতায়েন ন্যাটো বহরের আরেক অংশীদার ব্রিটেনের কোনও নৌসেনা আপাতত মার্কিন বিমানবাহী রণতরীটিতে থাকবেন না।
প্রসঙ্গত, গত আগস্টেও ওই এলাকায় টহলদারিতে থাকা ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’ দুর্ঘটনায় পড়েছিল।
বিমানবিধ্বংসী স্বয়ংক্রিয় কামান ও ক্ষেপণাস্ত্র, সি স্প্যারো ক্ষেপণাস্ত্র, ফ্যালন্যাক্স ‘ক্লোজ ওয়েপন সিস্টেম’ সমৃদ্ধ এই ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ডের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা অন্য বিমানবাহী রণতরীর তুলনায় সুদৃঢ় বলেই মনে করেন নৌ-প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের অনেকে।
ফোর্ড গোত্রের আরেক বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস জন এফ কেনেডি নির্মাণের কাজও ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। চলছে সমুদ্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পালা। এই গোত্রের ডরিস মিলার, এন্টারপ্রাইজ-সহ মোট পাঁচটি যুদ্ধজাহাজ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
তাইওয়ানের সঙ্গে চীনের সাম্প্রতিক সংঘাতের প্রেক্ষিতে আমেরিকা নৌসেনার আরেক বৃহৎ বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, নিমিৎজ গোত্রের ইউএসএস রোনাল্ড রেগানকে সম্প্রতি চীন সাগরে মোতায়েন করেছে পেন্টাগন। সূত্র: সিনেট, ইউরো এশিয়ান টাইমস, ন্যাভাল নিউজ, বিজনেস ইনসাইডার, সিবিএস নিউজ, ভয়েস অব আমেরিকা
বিডি প্রতিদিন/কালাম