প্রাচীন ভারত, তারও আগে ভারত মহাসাগরের পারে যে অংশ জম্বুদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল, সেই অংশকে ইউরোপের দেশগুলো চিনত একটাই কারণে। তা হল মশলা। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের মশলার জগৎজোড়া খ্যাতি। পশ্চিমের দেশগুলো মশলার সূত্রেই ভারতের সঙ্গে একসময় বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। সমুদ্র পেরিয়ে মশলা কিনতে আসতেন বিদেশি বণিকেরা। ভারতের মশলা জাহাজ বোঝাই হয়ে পাড়ি দিত বিদেশে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের মশলার খ্যাতি বেড়েছে, বেড়েছে বাণিজ্যও। এখনও অধিকাংশ দেশের মশলাপাতি কেনার অন্যতম ঠিকানা ভারত। ভারতের একাধিক নিজস্ব মশলার ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছে। তাদের মোড়কেই সেরা মশলা বিদেশে রফতানি করা হয়। কিন্তু ভারতের সেই বিখ্যাত মশলার সংস্থাগুলো সম্প্রতি বিতর্কের মুখে। এমডিএইচ, এভারেস্টের মতো ব্র্যান্ডের মশলা নিষিদ্ধ করেছে কিছু দেশ। কোনও কোনও দেশ আবার ভারতীয় মশলার গুণমান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছে। বিশ্ব বাজারে মশলায় মুখ পুড়েছে নয়াদিল্লির।
গত মাসেই প্রথমে সিঙ্গাপুর এবং হংকং ভারতের এমডিএইচ গোষ্ঠীর তিনটি এবং এভারেস্টের একটি মশলা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। অভিযোগ, মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক (এথিলিন অক্সাইড) রয়েছে ওই মশলায়, যা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। গতকাল শুক্রবার ভারতের প্রতিবেশী নেপালও এই দুই ব্র্যান্ডের মশলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। বলা হয়েছে, মশলাগুলো পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। চূড়ান্ত রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত দেশে ওই দুই ব্র্যান্ডের মশলা কেনা, বিক্রি করা বা ব্যবহার করা যাবে না।
যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডও ভারতীয় মশলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাজ্য জানিয়েছে, এই বিশেষ দুই ব্র্যান্ডের মশলা নিয়ে তারা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছে। ভারতের সমস্ত মশলার উপর নজরদারি চালাচ্ছে তারা। ভারতের মশলায় মূল বিতর্ক এথিলিন অক্সাইড নিয়েই। অভিযোগ, এই রাসায়নিক মশলা জীবাণুমুক্ত করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু মানুষের শরীরের পক্ষে এই মশলা অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই মশলা শরীরে বেশি গেলে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
আগে মশলা পরিশোধনে শুধু ভারত নয়, অন্যান্য দেশও এথিলিন অক্সাইড ব্যবহার করত। পরে এই রাসায়নিকের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা জানা যায়। তারপর থেকে বিভিন্ন দেশ এই রাসায়নিক ব্যবহার ধাপে ধাপে তুলে দিয়েছে। বিদেশে মশলায় নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সতর্ক হয়েছে নয়াদিল্লিও। সিঙ্গাপুর এবং হংকংয়ের নিষেধাজ্ঞার পর দেশের মশলা পর্ষদ বা স্পাইস বোর্ড রফতানিকারকদের উদ্দেশে জারি করেছে বিশেষ নির্দেশিকা।
জানানো হয়েছে, রফতানিকারীদের নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মশলা শোধন-সহ কোনও ক্ষেত্রেই এথিলিন অক্সাইড ব্যবহার না করা হয়। এ জন্য জলীয় বাষ্প ব্যবহার করার মতো খাদ্য নিয়ন্ত্রক এফএসএসএআই-এর অনুমোদিত বিকল্প পথ ব্যবহার করতে হবে। এভারেস্ট এবং এমডিএইচ ভারতের প্রধান এবং জনপ্রিয়তম দু’টি মশলা প্রস্তুতকারী সংস্থা। এই ব্র্যান্ডগুলোর মশলা বহন, গুদামজাত করা, প্যাকেজিং-এর পণ্য সরবরাহকারীরাও যাতে এথিলিন অক্সাইড ব্যবহার এড়িয়ে চলে, দেখতে বলা হয়েছে।
নির্দেশিকায় আরও জানিয়েছে, মশলার কাঁচামাল থেকে শুরু করে প্যাকেজিং এবং কীটনাশকের উপস্থিতি পরীক্ষা করতে হবে। কোনও সমস্যা হলে তা মেটানোর উপায়ও বার করতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে আবার ওই সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া, মশলা বস্তাবন্দি করার সময়ে জল না দেওয়া, পোকামাকড়ের উপদ্রব আটকাতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
যে দুই সংস্থার মশলার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, তারা কিন্তু ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। এভারেস্ট এবং এমডিএইচের দাবি, তাদের মশলা সম্পূর্ণ নিরাপদ। এরপরও একে একে বিভিন্ন দেশ ভারত থেকে মশলা কেনা বন্ধ করে দিলে, ভারতের বাণিজ্য মহলে তার বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। কারণ, মশলা থেকে প্রতি বছর বিপুল আয় হয় দেশের। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ৪১০ কোটি ডলারের মশলা রফতানি করেছিল ভারত। ভারত এখন বিশ্বের বৃহত্তম মশলা রফতানিকারী দেশ। ভারতের মশলার গুণমান নিয়ে প্রশ্ন উঠলে দেশের অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়তে পারে। তাই রাসায়নিক ব্যবহারের অভিযোগ খতিয়ে দেখে অবিলম্বে বিষয়টি নিয়ে সতর্ক হওয়া উচিত নয়াদিল্লির।
বিডি-প্রতিদিন/শআ