সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে জনগণের তীব্র অসন্তোষ রাজনৈতিক পালাবদলের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এবং নেপালে পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এই অঞ্চলের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল নির্দিষ্ট কিছু ছোট অভিযোগ নিয়ে। পরবর্তীতে সরকার পতন হয়েছে সেই আন্দোলনে।
এই বিক্ষোভগুলোর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষুব্ধ জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। তারা দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং দুর্নীতিবাজ অভিজাত শ্রেণির প্রতি হতাশ। এই গোষ্ঠীগুলোকেই তারা লাগামহীন দুর্নীতি, গভীর বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক দুর্ভোগের জন্য দায়ী মনে করে। তরুণ সমাজ প্রায়শই এই আন্দোলনগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছে, যা কখনো কখনো মারাত্মক সহিংস রূপ ধারণ করছে এবং প্রায়শই একটি রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করছে।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ পল স্ট্যানিল্যান্ড বলেন, শাসকগোষ্ঠী দুর্নীতিগ্রস্ত এবং জনগণের জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য পথ তৈরি করতে ব্যর্থ—এমন ধারণা থেকেই বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে।
সর্বশেষ সোমবার জনরোষের শিকার হয়েছে নেপাল। বছরের পর বছর ধরে চলা অসন্তোষের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের পর। সাধারণ মানুষ বিশেষভাবে আগে থেকেই ক্ষুব্ধ ছিলো। রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানেরা যেখানে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে, সেখানে সাধারণ জনগণ অর্থনৈতিক সংকট, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং ব্যাপক দুর্নীতির শিকার।
নেপালে প্রতিবাদকারীরা সুনির্দিষ্ট কোনো দাবি না জানালেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছিল। তারা পার্লামেন্ট ভবন, প্রেসিডেন্টের বাসভবন এবং বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। জনগণের চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং পদত্যাগ করেন।
নতুন সরকার কেমন হবে এবং সেখানে পুরোনো রাজনৈতিক নেতারা থাকবে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, সেই পুরোনো রাজনৈতিক শ্রেণিই আবারও ক্ষমতা ভাগাভাগির খেলায় মেতে উঠবে, যাদেরকে তারা ক্ষমতা থেকে সরাতে চেয়েছিল।
নেপালে রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রায়শই দেখা যায়। ২০১৫ সালে নতুন সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর থেকে সব প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ছিল মাত্র এক বা দুই বছর। ২০০৬ সালে একটি গণঅভ্যুত্থানে নেপালে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটেছিল।
বাংলাদেশ: গত বছর (২০২৪) জুলাই মাসে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হলেও তা দ্রুত একটি গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এই বিক্ষোভে শত শত মানুষ (যাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী) প্রাণ হারান। হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। তিনি দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর একটি নতুন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেন।
শ্রীলঙ্কা: শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালে গণবিক্ষোভ শক্তিশালী রাজাপাকসে পরিবারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। এরপর গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর হয় এবং গত বছর মার্কসবাদী রাজনীতিবিদ অনুরা কুমার দিসানায়েকা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, সরকারে স্বচ্ছতা আনা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের বিচারের মুখোমুখি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে পল স্ট্যানিল্যান্ড মন্তব্য করেছেন, নেপাল দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতার নতুন রূপকে তুলে ধরছে। নেপালে পরে কি ঘটবে, সবাই তা দেখার অপেক্ষায় আছেন।
সূত্র: এনডিটিভি
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল