শুধু একটি গাছ নয়, এ যেন ইতিহাসের নীরব প্রহরী। সময়ের স্রোতে ভেসে সে দেখেছে উপমহাদেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েন, স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা আর বিপ্লবী চেতনার উত্তাল দিনগুলো। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের নিজ হাতে রোপিত এই তমাল গাছ আজও স্মরণ করিয়ে দেয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বীরত্বগাথা। সরকারি বরিশাল কলেজের মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা এই বিশাল তমাল গাছটি স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘তমালতলা’ নামে। গাছটিকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য রাজনৈতিক ঘটনার স্মৃতি। অথচ ইতিহাসের এমন জীবন্ত নিদর্শন রক্ষায় নেই তেমন কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ। চারপাশে বেষ্টনী থাকলেও যথাযথ সংরক্ষণ ও পরিচর্যার অভাব স্পষ্ট।
সরকারি বরিশাল কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শারফিন আহমেদ শাফিন বলেন, ‘তমাল গাছটি শুধু কলেজেরই নয়, পুরো বরিশালের ঐতিহ্য। গাছটি অনেক পুরোনো, তাই পোকামাকড়ের আক্রমণও হয়। সেগুলোর প্রতিকার করার চেষ্টা চলছে- আমরা ঐতিহ্যটিকে ধরে রাখার চেষ্টা করছি।’ একই কলেজের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা আশিক মাহমুদ বলেন, ‘মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত নিজ হাতে এ গাছটি রোপণ করেছিলেন। জানা যায়, এশিয়া মহাদেশে এমন তমাল গাছ তিনটি রয়েছে, যার একটি এখানেই।’
কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাজ্জাদ বিন শাখাওয়াত জানান, ‘বিএম স্কুলেও একটি তমাল গাছ ছিল, কিন্তু সেটি ঝড়ে ভেঙে গেছে। বরিশাল কলেজ একসময় ছিল অশ্বিনী কুমারের বাসভবন। সেই বাসভবনের সামনেই এই গাছটি রোপণ করা হয়েছিল। বলা হয়, এই গাছতলায় বসেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পরিকল্পনা করা হতো।’ ইতিহাসের তথ্যমতে, তমাল গাছটি ছিল অশ্বিনী কুমারের বৈঠকখানার সামনে। এখানেই বসে তিনি বাংলার রাজনীতি পরিচালনা করতেন। মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাশ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, এ কে ফজলুল হক, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী প্রমুখ এই গাছতলায় বসে ভারতের ও বাংলার রাজনীতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন।
বরিশাল নগরীর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক স্বপন খন্দকার বলেন, ‘আগামী প্রজন্মকে জানাতে হলে ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ জরুরি। পরিবেশবিদ, সমাজসচেতন মানুষ ও শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে এ উদ্যোগে।’
সরকারি বরিশাল কলেজের অধ্যক্ষ আলী আহম্মেদ বলেন, ‘আমি নতুন যোগ দিয়েছি, তাই ঠিক কত বছর আগে গাছটি রোপণ করা হয়েছে বলতে পারব না। তবে ধারণা করা হয় এটি একশ বছরেরও পুরোনো। গাছটির নিয়মিত পরিচর্যা করা হয়- মাটি ও সার দেওয়া হয়, সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে।’
সময়, ইতিহাস ও স্বাধীনতার স্বপ্নের সাক্ষী এই তমাল গাছ কেবল একটি বৃক্ষ নয়- এটি এক যুগের প্রতীক। সংরক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে যদি একদিন এই ঐতিহ্য হারিয়ে যায়, তবে সেই ক্ষতি পূরণ করা অসম্ভব হবে। তাই সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা- যাতে ইতিহাসের এই বৃক্ষ বাঁচিয়ে রাখে আমাদের স্মৃতি, আগামী শতাব্দীতেও।