মধ্যরাত থেকে ভোররাত- টানা পাঁচ ঘণ্টার বৃষ্টিতে ডুবল কলকাতা। কলকাতার বিভিন্ন স্থানে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে, যার ফলে ব্যাহত স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। গড়িয়া, কসবা, সাদার্ন এভিনিউ, নাগেরবাজার, লেক মার্কেট, বোসপুকুর তালবাগান, যাদবপুর, চেতলা, পাকসারকাস প্রতিটি জাগাতেই পানি থৈ থৈ অবস্থা। জলমগ্ন কলকাতার আরজিকর মেডিকেল হসপিটাল চত্ত্বর।
স্বাভাবিকভাবেই উত্তর কলকাতা থেকে দক্ষিণ কলকাতা কার্যত নদীতে পরিণত হয়েছে। কোথাও হাঁটু সমান পানি, কোথাও আবার কোমর সমান। আর এই বৃষ্টির কারণে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে পাঁচ জনের। এতটাই খারাপ অবস্থায় যে পানিতে বিদ্যুতের তার ছিড়ে পড়ার কারণে দীর্ঘক্ষণ পানির উপরেই পরে থাকে সেইসব লাশ। শহরবাসীরাই জানাচ্ছে, সাম্প্রতিককালে এরকম ভয়াবহ চিত্র তাদের মনে পড়ছে না।
কলকাতা আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, সোমবার রাত ১২টা থেকে মঙ্গলবার ভোর ৫ পর্যন্ত পাঁচ ঘণ্টার ব্যবধানে কলকাতায় রেকর্ড ৩৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।
ভোর ৫টা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন এলাকায় যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে, তা এরকম: কামডহরি (গড়িয়া) – ৩৩২ মিমি, যোধপুর পার্ক – ২৮৫ মিমি, কালীঘাট– ২৮০.২ মিমি, তাপসিয়া– ২৭৫ মিমি, বালিগঞ্জ – ২৬৪ মিমি, চেতলা - ২৬২ মিমি, মোমিনপুর - ২৩৪ মিমি। চিঙ্গাদিহাটা - ২৩৭ মিমি, পামার মার্কেট - ২১৭ মিমি, ধাপা - ২১২ মিমি, উল্টোডাঙ্গা - ২০৭ মিমি, কুদঘাট - ২০৩.৪ মিমি, পাগলডাঙ্গা (টাঙ্গারা)- ২০১ মিমি, কুলিয়া (টাঙ্গারা)- ১৯৬ মিমি, ঠনঠনিয়া - ১৯৫ মিমি।
একটানা বৃষ্টির কারণে বহু পুজো মন্ডপও ক্ষতিগ্রস্ত। কসবা বোসপুকুর তালবাগান সার্বজনীন পূজা কমিটির থিমের জাহাজ পানির তলায়। বেশি বৃষ্টিতে এপিসি রোডে ভেঙে যায় পুজোর মন্ডপ।
টানা বৃষ্টিতে ব্যাহত ট্রেন চলাচল, রেল পরিষেবা, বাস পরিষেবা। ফলে সপ্তাহের শুরুতেই পথে বেরিয়ে চরম দুর্ভোগের শিকার সাধারণ যাত্রীরা। শিয়ালদহ মেন ও দক্ষিণ শাখায় ট্রেন চলাচল বিপর্যস্ত। বিভিন্ন রেল স্টেশনে একের পর এক ট্রেন দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রবল বৃষ্টির কারণে কলকাতা রেল স্টেশন থেকে দূরপাল্লার কয়েকটি ট্রেন বাতিল এবং সময়সূচী পরিবর্তন করা হয়েছে।
ট্র্যাকে পানি ঢুকে ব্যাহত মেট্রো পরিষেবাও। এদিন সকালের দিকে রাস্তায় হাতে গোনা কয়েকটি বাসের দেখা মেলে। তাতেই ছিল বাদুড় ঝোলা অবস্থা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কলকাতায় জমা পানিতে মৃত্যু হয়েছে চার জনের। সকালে সাড়ে ছয়টা নাগাদ কলকাতার কালিকাপুর অভিষিক্তা মোড়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন মাঝ বয়সি এক ব্যক্তি। হঠাৎ করেই ভারসাম্য হারিয়ে বিদ্যুতের খুঁটিতে হাত দিতেই সাইকেল থেকে পড়ে যান, ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় ওই ব্যক্তির।
জলমগ্ন বেহালার নেতাজি নগর মোড়ে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় প্রশান্ত কুণ্ডু নামে এক ব্যক্তির। গড়িয়াহাটের বালিগঞ্জ প্লেসে একজনের মৃত্যু হয়। বেনিয়াপুকুর এবং মোমিনপুরেও একজন করে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
শহরে জমা পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য একদিকে যেমন পাম্প লাগিয়ে কলকাতা পুরসভা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তেমনি বিপর্যয় এড়াতে কলকাতা পুরসভার তরফে সতর্কতাও জারি করা হয়েছে। প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বেরোতে নিষেধ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুতের খুঁটি স্পর্শ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
রাতভর বৃষ্টিতে জলমগ্ন হাওড়া শহর। হাওড়া পুরসভার কমপক্ষে ২৫টি ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এমনকি রাজ্য সরকারের সচিবালয় 'নবান্ন'এর চারপাশে থৈ থৈ করছে পানি। পানি ঢুকে গেছে দুর্গা পুজোর প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে। এতে উদ্বিগ্ন পুজো সংগঠকরা। হাওড়া ডিভিশনের টিকিয়াপাড়া কারশেডে রেল ট্রাকে পানি জমে যাওয়ার ফলে ব্যাহত ট্রেন চলাচল। শালিমার স্টেশনে সিগনাল সিস্টেম খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণে ব্যাহত ট্রেন চলাচল। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সিগন্যাল সারানোর কাজ চলছে। কলকাতা, হাওড়াসহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতেও টানা বৃষ্টিতে একাধিক জায়গায় পানি জমে গেছে।
কলকাতা পৌরসভা জানিয়েছে, অস্বাভাবিক পানি জমেছে। কলকাতা শহরে পানি জমে যাওয়া এবং তার মোকাবিলা করাটাই আমাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। নতুন করে বৃষ্টি না হলে রাত দশটার মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। শহরের কোন কোন এলাকায় ৩০০ মিলিমিটার পানি জমেছে সেক্ষেত্রে ১০০ মিলিমিটার পানি সরাতে ৫ ঘন্টা সময় লাগে, ৩০০ মিলিমিটার পানি সরাতে ১৫ ঘন্টা সময় লাগার কথা। কিন্তু আমরা অতটা সময় নেব না। আমরা চেষ্টা করছি পানিটা যত তাড়াতাড়ি নামানো যায়। এত পানি কখনো জমে নি, তাই নিচু এলাকায় বিদ্যুতের সামনে না যাওয়াই ভালো।
বিডি প্রতিদিন/এএম