বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে আলোচিত হচ্ছে ডকট্রিন অব নেসেসিটি বা প্রয়োজনীয়তার মতবাদ।
মধ্যযুগীয় ইংরেজ আইনবিদ ও জুরি হেনরি ডি ব্র্যাকটনের লেখায় ‘প্রথম ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র ধারণা পাওয়া যায়। এটি হলো এমন পদক্ষেপ, ‘যা আইনে বৈধ নয়, কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে তা বৈধ করা।’
ইসলামী আইনশাস্ত্রে এটি স্বীকৃত আইনি পদক্ষেপ।
কেননা ইসলামী আইন মানুষের বিশ্বাস-মূল্যবোধ, জীবন-সম্পদ, সম্মান-সম্ভ্রম, সামাজিক-অর্থনৈতিক সব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই ইসলামী শরিয়তের বিধি-বিধান প্রণয়নের প্রধান পাঁচটি উদ্দেশ্য হলো মানবজীবনের পাঁচটি বিষয়ের নিরাপত্তা প্রদান। যেমন—বিশ্বাসের নিরাপত্তা, জীবনের নিরাপত্তা, সম্পদের নিরাপত্তা, মানব বংশক্রমের নিরাপত্তা ও ধারাবাহিকতা এবং মেধা ও বিবেকের সুরক্ষা। আর এসব হলো জরুরত তথা অত্যাবশ্যকীয়তা।
এসব জরুরতের কারণে অবস্থাভেদে আইনের কঠোরতা ও সহজীকরণ নির্ধারিত হয়।
বিশেষ অবস্থায় আইনের সহজীকরণ
ইসলামী আইনের একটি মূলনীতি হলো : ‘আজ-জরুরাতু তুবিহুল মাহজুরাত’ অর্থাৎ অত্যাবশ্যকীয়তা ও অনিবার্য প্রয়োজন নিষিদ্ধ বস্তুকে বৈধ করে দেয়। [আল আশবাহ ওয়ান নাজাইর, ইবনে নুজাইম, পৃষ্ঠা-৭৩ (শামেলা); আল-ওয়াজিয ফি উসুলিল ফিকহি, ড. আবদুল কারিম জায়দান, পৃষ্ঠা-৩৮৪)]
এই মূলনীতির উদাহরণ হলো—জীবন বাঁচানোর জন্য মৃত জন্তুর গোশত খাওয়া, জীবন ধারণের জন্য অন্য কোনো খাবার না থাকা অবস্থায় শূকরের মাংস খাওয়া, পিপাসা নিবারণের জন্য কোনো ধরনের হালাল পানি বা পানীয় না থাকা অবস্থায় মদ পান করা ইত্যাদি। নিরুপায় অবস্থায় এসব হারাম বস্তু শর্তসাপেক্ষে গ্রহণ করার সুযোগ আছে।
কোরআন-হাদিসের আলোকে বিশেষ অবস্থায় আইনের শিথিলতা
পবিত্র কোরআনের কয়েকটি আয়াত থেকে ইসলামী আইনের এই মূলনীতি গ্রহণ করা হয়েছে যে নিরুপায় অবস্থায় হারাম বস্তু বা পন্থা শর্তসাপেক্ষে গ্রহণ করার সুযোগ আছে। যেমন—
১. পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘যে জন্তুর ওপর জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়েছে, তা আহার না করার তোমাদের কাছে কী কারণ থাকতে পারে? অথচ আল্লাহ তোমাদের ওপর যা কিছু হারাম করেছেন তা তিনি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। তবে নিরুপায় অবস্থায় তোমরা উক্ত হারাম বস্তুও আহার করতে পারো...।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১১৯)
২. পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি হারাম করেছেন মৃত জীব, রক্ত ও শূকরের মাংস এবং ওই জন্তু, যার প্রতি আল্লাহ ছাড়া অন্যের নাম নেওয়া হয়েছে। তবে যে ব্যক্তি নিরুপায় হয়ে পড়ে, কিন্তু সে পাপী ও সীমা লঙ্ঘনকারী নয়, তার ওপর কোনো গুনাহ নেই, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৭৩)
৩. মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের জন্য মৃত জীব, রক্ত, শূকরের মাংস, আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গীকৃত পশু, কণ্ঠরোধে মারা পশু, আঘাত লেগে মরে যাওয়া পশু, পতনের ফলে মৃত পশু, শৃঙ্গাঘাতে মৃত পশু এবং হিংস্র জন্তুতে খাওয়া পশু হারাম করা হয়েছে; তবে যা তোমরা জবাই দ্বারা পবিত্র করেছ তা হালাল। আর যেসব পশুকে পূজার বেদির ওপর বলি দেওয়া হয়েছে তা এবং জুয়ার তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ণয় করাও তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে। এসব কাজ পাপ।...কিন্তু কেউ পাপের দিকে না ঝুঁকে ক্ষুধার তাড়নায় আহার করতে বাধ্য হলে সেগুলো খাওয়া তার জন্য হারাম হবে না। কারণ নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৩)
৪. মহান আল্লাহ বলেন, ‘বলে দাও, আমার প্রতি যে ওহি পাঠানো হয়েছে তাতে মানুষ যা আহার করে তার কিছুই নিষিদ্ধ পাইনি মৃত, প্রবহমান রক্ত ও শূকরের মাংস ছাড়া। কারণ তা অপবিত্র কিংবা এমন অবৈধ, যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য জবাই করা হয়েছে। তবে যে ব্যক্তি নিরুপায় হয়ে পড়ে কিন্তু সে নাফরমান ও সীমা লঙ্ঘনকারী নয়, তাহলে তোমার প্রতিপালক বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ১৪৫)
৫. পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য হারাম করেছেন মৃত জীব, রক্ত, শূকরের মাংস আর যা জবাই করার সময় আল্লাহ ছাড়া অন্যের নাম নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে অবাধ্য না হয়ে ও সীমা লঙ্ঘন না করে নিতান্ত নিরুপায় (হয়ে এসব খেতে বাধ্য) হলে আল্লাহ তো বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু।’
(সুরা : নাহল, আয়াত : ১১৫)
এ ছাড়া পবিত্র কোরআনের একটি মূলনীতি হলো সহজীকরণ। কোরআনে এসেছে : ‘...আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না...।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৫)
অনিবার্য প্রয়োজনে নিষিদ্ধ বস্তুকে বৈধ করে দেওয়ার নজির হাদিসেও দেখা যায়। জাবের ইবনু সামুরা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি তার পরিবার-পরিজন নিয়ে ‘হাররা’ নামক স্থানে যাত্রাবিরতি করল। অন্য এক ব্যক্তি তাকে বলল, আমার একটি উট হারিয়ে গেছে। তুমি তা পেলে ধরে রাখবে। সে উটটি পেয়ে গেল, কিন্তু মালিককে পেল না। উটটি অসুস্থ হয়ে পড়লে তার স্ত্রী তাকে বলল, এটা জবাই করো, কিন্তু সে জবাই করতে সম্মত হলো না। উটটি মারা গেলে তার স্ত্রী বলল, এর চামড়া ছাড়াও, তাহলে এর গোশত ও চর্বি আগুনে জ্বালিয়ে খেতে পারব। স্বামী বলল, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে প্রশ্ন করে দেখি। সে তাঁর কাছে এসে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, তোমার কাছে এমন কি কিছু আছে, যা তোমাকে মৃত জন্তু খাওয়া থেকে মুখাপেক্ষিহীন করতে পারে? সে বলল, না। তিনি বলেন, তাহলে তা খাও।
(আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮১৬)
সুতরাং পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে সুস্পষ্টভাবে জানা গেল যে ক্ষেত্রবিশেষে অনিবার্য কারণে আইনের ব্যত্যয় ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে জরুরত বা অত্যাবশ্যকীয়তা তথা (প্রচলিত পরিভাষায়) ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ আগের আইন সাময়িক স্থগিত করে ‘প্রয়োজনের আইন’ রচনা করতে পারে।
প্রয়োজন পূরণ হলে আইন আগের মতো কার্যকর
ইবনে নুজাইম (রহ.) উল্লিখিত মূলনীতির সঙ্গে আরো একটি মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। সেটি হলো অনিবার্য কারণে যে নিষিদ্ধ বস্তুর বৈধতা দেওয়া হয়েছে, তা প্রয়োজন পূরণের সঙ্গে সীমাবদ্ধ থাকবে। অর্থাৎ প্রয়োজন পূরণ হয়ে গেলে আইন আগের জায়গায় কার্যকর থাকবে। [আল আশবাহ ওয়ান নাজাইর, ইবনে নুজাইম, পৃষ্ঠা-৭৩ (শামেলা)]
যেমন—ডাক্তার অনিবার্য কারণে রোগীর লজ্জাস্থান দেখতে পারবেন, তবে ততটুকু দেখবেন যতটুকু চিকিৎসার জন্য দেখা প্রয়োজন। এর বেশি নয়।
তাই বোঝা যাচ্ছে যে বিশেষ অবস্থায় আইনি শিথিলতা শর্তহীন হয়, বরং এ ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত আছে—
১. অনিবার্য প্রয়োজন (জরুরত) বিদ্যমান হওয়া।
২. এই নিষিদ্ধ পথ ও পন্থা গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় না থাকা।
৩. যে পন্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা সংকট উত্তরণে অকাট্যভাবে কার্যকর হওয়া।
৪. কোনো আইন স্থগিত করতে গিয়ে বিদ্যমান সংকটের চেয়ে বড় কোনো সংকট তৈরি না করা।
কিছু আইন কখনো পরিবর্তন হয় না
এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার, সেটি হলো ইসলামী শরিয়তে কিছু নিষিদ্ধ বিষয় এমন আছে, কোনো অবস্থায়ই সেগুলোর নিষিদ্ধতা অকার্যকর হয় না। কোনো অবস্থায়, এমনকি জীবনের ঝুঁকি থাকলেও
কয়েকটি কাজের কখনো বৈধতা দেওয়া হয় না। যেমন—কোনো মুসলমানকে হত্যা করা (কেউ বাধ্য করলেও হত্যা করা বৈধ নয়), কারো অঙ্গহানি করা, মা-বাবাকে আঘাত কিংবা হত্যা করা ইত্যাদি।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন