বান্দার প্রতি আল্লাহর সবচেয়ে সুন্দর সম্বোধন হলো ‘হে ঈমানদার বা ওহে যারা ঈমান এনেছ’। কারণ এভাবে সম্বোধনের পর আল্লাহ কখনো মুমিনদের এমন কার্যাবলির নির্দেশ দেন, যার মধ্যে নিহিত থাকে মুমিন বান্দার সৌভাগ্য ও চূড়ান্ত সফলতা। কখনো কিছু বিষয়ে নিষেধও করেন। সেসব নিষিদ্ধ বিষয়ে নিহিত থাকে অকল্যাণ আর অনিষ্টতা।
পবিত্র কোরআন মাজিদে প্রায় ৮৯ জায়গায় মুমিনদের আল্লাহ এভাবে সম্বোধন করেছেন। বিখ্যাত সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-কে একবার এক ব্যক্তি অনুরোধ করলেন কিছু নসিহা করার জন্য। তখন তিনি বলেন, যখন তুমি আল্লাহ তাআলাকে শুনবে যে তিনি বলছেন, ‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছ!’ তখন তুমি উত্কর্ণ হয়ে উঠবে। কেননা এমন সম্বোধনের পরে তিনি হয়তো কল্যাণকর কোনো বিষয়ের আদেশ করবেন অথবা অনিষ্টকর কোনো বিষয়ে নিষেধ করবেন। (তাফসিরে ইবনে আবি হাতেম : ১/১৯৬, তাফসিরে ইবনে কাসির : ১/৩২৫)
তাই এই আদুরে ডাকের পর আল্লাহ তাআলা কী বলছেন তা আমাদের মনোযোগসহ শোনা উচিত। এখানে মুমিনদের প্রতি আল্লাহর কয়েকটি নির্দেশ ও নিষেধ তুলে ধরা হলো—
ইসলামে পুরোপুরি প্রবেশের নির্দেশ : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, ইসলামে পুরোপুরি প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চিত জেনো, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২০৮)
নবীর প্রতি অসম্মানসূচক শব্দ ব্যবহার নিষিদ্ধ : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা (নবীকে) রা‘ইনা বলো না, বরং উনজুরনা বলো এবং শোন। আর কাফিরদের জন্য আছে মর্মন্তুদ শাস্তি।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১০৪)
খোঁটা দিয়ে দান-সদকা নষ্ট না করার নির্দেশ : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা খোঁটা ও কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে তোমাদের দান-সদকা বাতিল কোরো না। সে ব্যক্তির মতো, যে তার সম্পদ ব্যয় করে লোক-দেখানোর উদ্দেশ্যে এবং বিশ্বাস করে না আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি...।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৬৪)
বিধর্মীদের বন্ধুরূপে গ্রহণ না করার নির্দেশ : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, ইহুদি ও নাসারাদের তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ কোরো না। তারা একে অপরের বন্ধু।
আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, সে নিশ্চয়ই তাদেরই একজন। নিশ্চয়ই আল্লাহ জিলিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৫১)
ঋণ নেওয়ার পর লিখে রাখার নির্দেশ : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরস্পর ঋণের লেনদেন করবে, তখন তা লিখে রাখবে। আর তোমাদের মধ্যে একজন লেখক যেন ইনসাফের সঙ্গে লিখে রাখে এবং কোনো লেখক আল্লাহ তাকে যেরূপ শিক্ষা দিয়েছেন, তা লিখতে অস্বীকার করবে না...।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৮২)
সর্বাবস্থায় ধৈর্য ধারণের নির্দেশ : পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করো এবং সর্বদা আল্লাহর পথে প্রস্তুত থাকো, আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ২০০)
হালাল রিজিক ভক্ষণের নির্দেশ : আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, আমি তোমাদের জীবিকারূপে যে উত্কৃষ্ট বস্তুসমূহ দিয়েছি, তা থেকে (যা ইচ্ছা) খাও এবং আল্লাহর শুকর আদায় করো—যদি তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করে থাকো।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৭২)
আল্লাহর দেওয়া রিজিক থেকে দান করার নির্দেশ : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে সেই দিন আসার আগেই (আল্লাহর পথে) ব্যয় করো, যেদিন কোনো বেচাকেনা থাকবে না, কোনো বন্ধুত্ব (কাজে আসবে) না এবং কোনো সুপারিশও না। আর যারা কুফর অবলম্বন করেছে তারাই জালিম।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৫৪)
আল্লাহর ভয় ও তাঁর দ্বিন আঁকড়ে ধরার নির্দেশ : ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো—যথাযথ ভয়। আর তোমরা মুসলমান হওয়া ছাড়া মারা যেয়ো না। আর তোমরা সবাই আল্লাহর রশিকে (অর্থাৎ তার দ্বিন ও কিতাবকে) দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং বিভক্ত হয়ো না। (সুরা : আল ইমরান, আয়াত : ১০২ ও ১০৩)
আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্যের নির্দেশ : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রাসুলের ও তোমাদের নেতাদের।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৯)
আল্লাহর নিয়ামত স্মরণ করার নির্দেশ : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা স্মরণ করো তোমাদের ওপর আল্লাহর নিয়ামত, যখন একটি কওম তোমাদের প্রতি তাদের হাত প্রসারিত করতে মনস্থ করল; কিন্তু তিনি তাদের হাত তোমাদের থেকে নিবৃত্ত রাখলেন। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আল্লাহর ওপরই মুমিনরা যেন তাওয়াক্কুল করে।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ১১)
শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ না করার নির্দেশ : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। আর যে শয়তানের পদাঙ্কসমূহ অনুসরণ করবে, নিশ্চয়ই সে অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেবে।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ২১)
অনুমতি ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশ নিষিদ্ধ : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা নিজদের গৃহ ছাড়া অন্য কারো গৃহে প্রবেশ কোরো না, যতক্ষণ না তোমরা অনুমতি নেবে এবং গৃহবাসীদের সালাম দেবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ২৭)
নেশাগ্রস্ত ও অপবিত্র অবস্থায় নামাজ না পড়ার
নির্দেশ : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না, যতক্ষণ না তোমরা বুঝতে পারো যা তোমরা বলো এবং অপবিত্র অবস্থায়ও না, যতক্ষণ না তোমরা গোসল করো, তবে যদি তোমরা পথ অতিক্রমকারী হও। আর যদি তোমরা অসুস্থ হও বা সফরে থাক অথবা তোমাদের কেউ প্রস্রাব-পায়খানা থেকে আসে কিংবা তোমরা স্ত্রী সম্ভোগ করো, তবে যদি পানি না পাও তাহলে পবিত্র মাটিতে তায়াম্মুম করো। সুতরাং তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাত মাসেহ করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ মার্জনাকারী, ক্ষমাশীল।’
(সুরা : নিসা, আয়াত : ৪৩)
আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আমানত রক্ষা করা : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহ ও রাসুলের খিয়ানত কোরো না। আর জেনেবুঝে খিয়ানত কোরো না নিজদের আমানতের।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ২৭)
কাউকে মন্দ নামে না ডাকার নির্দেশ : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা একে অপরের নিন্দা কোরো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ উপনামে ডেকো না। ঈমানের পর মন্দ নাম কতই না নিকৃষ্ট! আর যারা তাওবা করে না, তারাই তো জালিম।’(সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১১)
গিবত না করা ও অনুমান করে কথা না বলা : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা বেশি অনুমান থেকে দূরে থাকো। নিশ্চয়ই কোনো কোনো অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান কোরো না এবং একে অপরের গিবত কোরো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাকো। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ বেশি তাওবা কবুলকারী, অসীম দয়ালু।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১১)