ফুল কার না ভালো লাগে! ফুলের বাগান আরও বেশি মন কাড়ে! ফুল অথবা ফুলের বাগানের পেছনে একজন মালির মায়া থাকে। খাঁ খাঁ খোলা মাঠে ফুলের বাগান সাজানোর জন্য হৃদয় নিংড়ানো দরদ লাগে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তার সঙ্গে এক নদী দরদ মিশিয়ে যত্ন নিতে হয়। তবেই সে বাগানে রংবেরঙের ফুল ফোটে। দূরদূরান্তের মৌ আসে। যে দেখে সে-ই হাসে। যত দেখে ততই হাসে। হাসতে হাসতে ভালোবাসে। ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথে। সে মালায় প্রেম হয়। এ তো গেল গাছে ফোটা ফুলের কথা। আজ বলব ইসলাম নামক প্রেমের বাগানে হাজারো মালির মাঝে অনন্য একজন মালির কথা। লোকে তাঁকে হজরতজি নামে চেনে। মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) তাঁর নাম। ভারতবর্ষে একামতে দীনের প্রাণপুরুষ শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভি (রহ.)-এর বিপ্লবী চিন্তায় প্রভাবিত ছিলেন তিনি। জীবনীকাররা লিখেছেন, বিপ্লব তার ঘরের সম্পদ ছিল। হজরতজির বড় আব্বা মাওলানা মোজাফফর হোসাইন ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সিপাহশালার সাইয়েদ শহিদ আহমদ বেরলভির (রহ.) ঘনিষ্ঠ সহচর। হজরতজির শৈশব কেটেছে বালাকোট আন্দোলন, বেরলভির জেহাদ ও শাহ আবদুল আজিজের এলমি সাধনার গল্প শুনে। পরিণত বয়সে তাই আফসোস করে তিনি বলেছিলেন, ‘হায়! এখনকার মুরব্বিরা শিশুদের ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীর গল্প শুনিয়ে বড় করেন। আর আমরা বড় হয়েছি শহীদের বিরত্বগাথা শুনে।’
ছোটবেলা থেকেই দীনের প্রতি গভীর দরদ ছিল ইলিয়াস (রহ.)-এর। তাঁর নানি আম্মা ছোট্ট ইলিয়াসের দীনি জজবা দেখে প্রায়ই বলতেন, ‘তোমার আখলাকে সাহাবিদের ছাপ রয়েছে।’ বড়বেলায় শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসানও একই কথা বলেছেন- ‘মাওলানা ইলিয়াসের আখলাকে আমি সাহাবিদের ছায়া দেখতে পাই।’ তাঁর এক মক্তবের সহপাঠী বলেন, ‘একদিন ছোট্ট ইলিয়াস একটি লাকড়ি হাতে নিয়ে এসে বলছে, দোস্ত! চলো, বেনামাজিদের বিরুদ্ধে জিহাদ করি।’ দীনের জন্য হজরতজির দিলে তো আগে থেকেই তড়প ছিল, সেটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গোহী (রহ.)। দীর্ঘ ১০ বছর ইলমের এই বিশাল বৃক্ষের ছায়ায় তিনি শুধু শরিয়ত শেখেননি, মারেফাতের সাগরেও সাঁতার কেটেছেন মন খুলে। ওই সময়ে ভারতবর্ষে গাঙ্গোহ ছিল জ্ঞান চর্চার জন্য প্রসিদ্ধ এলাকা। এখানে শুধু কিতাবি এলেমেরই চর্চা হতো না বরং একামতে দীনেরও ফিকির হতো। এ সময়ের ইসলামি আন্দোলনের কাঠামো ছিল মুসলমানদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার জিহাদি প্রচেষ্টারূপে। গাঙ্গোহে সকালবিকাল যে জিকিরের মজলিস হতো সেখানে দুনিয়ারজুড়ে মুসলমানদের সমস্যার পাশাপাশি ভারতবর্ষে কীভাবে ইসলামের সুদিন ফিরে আসবে সে আলোচনা হতো। এভাবে ১০ বছর পরাজিত-পতিত মুসলমানদের টেনে তোলার আলোচনা নানা আঙ্গিকে, নানা বর্ণে-ঢঙে শুনতে শুনতে মুসলমানদের জন্য বিপ্লবী কিছু করার ফিকির স্থায়ী হয়ে যায় তরুণ ইলিয়াসের বুকে।
যে বুকে স্বপ্ন থাকে, সে বুকে ব্যথা থাকে। স্বপ্ন পূরণ করার ব্যথা। আর এ ব্যথা আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। তরুণ ইলিয়াসের বুকেও স্বপ্ন ছিল। ছিল স্বপ্নপূরণের বেদনা। একদিন তিনি শায়েখ গাঙ্গোহীকে বলেন, ‘যখন আমি জিকিরে বসি, বুক খুব ভার লাগে।’ গাঙ্গোহী (রহ.) খুব অবাক হয়ে বললেন, ‘ঠিক একই কথা মাওলানা কাসিম নানুতুবি (রহ.) তাঁর পীর হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মক্কীকে বলেছিলেন। জবাবে মুহাজির মক্কী বলেছিলেন, ‘আল্লাহ তোমাকে দিয়ে দীনের বড় খেদমত করাবেন।’ এরপরই উপমহাদেশে সবচেয়ে বড় মাদরাসা দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। আর হজরতজি ইলিয়াস (রহ.) প্রতিষ্ঠা করেন তাবলিগ জামাত। দেওবন্দ মাদরাসা আর তাবলিগ জামাতের মধ্যে আরও একটি মিল রয়েছে। দুটোর পেছনেই রয়েছে রসুলের (সা.) অনুমোদনের গল্প। আলেমরা বলেন, স্বপ্নে এসে নবীজি (সা.) দেওবন্দ মাদরাসার সীমানা দেখিয়ে দেন কাসিম নানুতুবিকে। আর ইলিয়াস (রহ.)-কে দেন তাবলিগের সবক। বলছিলাম, হজরতজির বুকের স্বপ্ন তাবলিগ হয়ে পাখা মেলেছে মেওয়াতের মাটিতে। মেওয়াত থেকে তাবলিগের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর আনাচকানাচে। ১০০ বছরেরও বেশি সময় তাবলিগ আলো বিলাচ্ছে দীন জানে না, নামাজ জানে না, কালেমা জানে না, অজু জানে না, গোসল জানে না এমন মানুষের কাছে। সময়ের ব্যবধানে সবকিছুই আপডেট করতে হয়। তাবলিগ জামাতকেও আপডেট হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চিন্তা বোঝার মতো মন নিয়ে দাওয়াতের মাঠে ছড়িয়ে পড়তে হবে সাথি ভাইদের। আধুনিক তরুণীর মনে জাগা প্রশ্নের জবাব দেওয়ার এলমি দক্ষতা অর্জন করতে হবে মাস্তরাত জামাতকে। অর্থনীতি-রাজনীতি-সমাজনীতিতে পারদর্শী করার জন্য যুগোপযোগী একটি সিলেবাস করতে পারলে তাবলিগের সৌরভে সময়ের ফ্লেভার যোগ হবে। ব্যক্তি সংশোধনের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্র সংশোধনের জন্যও ফিকির করতে হবে তাবলিগের মুরব্বিদের। তবেই তাবলিগ জয় করবে আধুনিক বিশ্বকে।
লেখক : চেয়ারম্যান, জামালী তালিমুল কোরআন ফাউন্ডেশন এবং খতিব, রূপায়ণ টাউন সেন্ট্রাল মসজিদ
বিডি প্রতিদিন/এমআই