১১ রজব ১৪৪৬ হিজরি/১১ জানুয়ারি ২০২৫ ইসলামাবাদে রাবেতায়ে আলমে ইসলামীর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর এক দিন আগে একটি আলেম সম্মেলনের আয়োজন করা হয়, যেখানে সম্মানিত মুফতি তাকি উসমানি আরবি ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। তিনি এই সম্মেলনের মূল বিষয় নারীশিক্ষা-সংশ্লিষ্ট শরয়ি দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত পরিমিত ও ভারসাম্যপূর্ণভাবে তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে তিনি শিক্ষাবিষয়ক চিন্তার পাশাপাশি গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার শিকার মেয়েশিশু, মা-বোনদের দুরবস্থার প্রতিও শ্রোতা ও নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন।
সর্বসাধারণের উপকারার্থে তাঁর বক্তব্যের বাংলা অনুবাদ এখানে তুলে ধরা হলো। বক্তব্যটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মুফতি মাহমুদ হাসান
নারীশিক্ষার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিসর্বপ্রথম আমি আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করি, যিনি আমাদের এই বরকতময় জমায়েতে একত্র হওয়ার তাওফিক দান করেছেন। এ এক শুভ উপলক্ষ, যেখানে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর নির্বাচিত আলেমরা এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চিন্তাচর্চার জন্য একত্র হয়েছেন।
এর পাশাপাশি আমি রাবেতায়ে আলমে ইসলামী এবং এর সম্মানিত সেক্রেটারি জেনারেল শ্রদ্ধেয় শায়খ ড. মুহাম্মদ বিন আবদুল করিম ঈসার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যিনি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি পাকিস্তানে এই সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। তিনি রাবেতায়ে আলমে ইসলামীর প্ল্যাটফর্ম থেকে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার যে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, আল্লাহ তাআলা তাঁকে তার উত্তম প্রতিদান দিন।
যথার্থ বলতে গেলে, এই সম্মেলনের মূল বিষয়বস্তু নারীশিক্ষা নিয়ে আমাদের বিজ্ঞ ও সম্মানিত আলেমরা এরই মধ্যে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেছেন। আমি তাঁদের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করতে চাই না, কারণ এই বিষয়টি এখন প্রায় সবার দৃষ্টিতে এক এবং সর্বসম্মত একটি বিষয়।
আমার পক্ষে শুধু এটুকু বলা যথেষ্ট হবে যে ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া পাকিস্তানের সভাপতি হিসেবে, যে প্রতিষ্ঠান বর্তমানে পাকিস্তানজুড়ে প্রায় ২৫ হাজার মাদরাসার তত্ত্বাবধান করছে, আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে এই সংস্থার অধীন পরীক্ষাগুলোতে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই ছাত্রী, আর এক-তৃতীয়াংশ ছাত্র (উল্লেখ্য যে আমাদের বাংলাদেশের মাদরাসাগুলোতেও পরিস্থিতি ও পরিসংখ্যান প্রায় এমনই)। এই বাস্তবতা একথার সুস্পষ্ট প্রমাণ যে পাকিস্তানে আলেমসমাজের দৃষ্টিতে নারীশিক্ষার গুরুত্ব কোনোভাবেই বিশ্বের অন্য দেশগুলোর তুলনায় কম নয়।
নারীশিক্ষায় পশ্চিমা ধারণা ও ইসলামী ধারণার পার্থক্য
তবে আমি আপনাদের দৃষ্টি নারীদের শিক্ষার এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতি আকৃষ্ট করতে চাই। তা হলো-ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর সামাজিক ভূমিকা পশ্চিমা ধারণার তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই পার্থক্য শুধু তাত্ত্বিক নয়, বরং বাস্তব জীবনের সীমা ও শর্তাবলিতেও তা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, যেগুলো ইসলামী শরিয়ত দ্বারা নির্ধারিত।
আমাদের উচিত নয় যে নারীদের শিক্ষার বিষয়টি আমরা পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির চশমা দিয়ে বিচার করি। এমন ভাবা ঠিক নয় যে পশ্চিম থেকে আসা প্রতিটি বিষয়কেই যাচাই-বাছাই ছাড়াই তার সব নেতিবাচক দিকসহ গ্রহণ করতে হবে; সে যতই আমাদের জন্য উপকারী হোক কিংবা ক্ষতিকর।
আমাদের প্রথম দায়িত্ব এই যে আমরা নারীশিক্ষার বিষয়টিকে ইসলামী শিক্ষার আলোকে বিবেচনা করব, যেখানে পুরুষ ও নারীর অধিকার, কর্তব্য এবং সামাজিক ভূমিকায় পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত আছে।
এটা ঠিক যে কিছু মানুষ নারীশিক্ষার ওপর কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করছেন, তা নিয়ে আমাদের অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং আমি নিজেও তাঁদের অন্তর্ভুক্ত। তবে তাঁদের এই বিধি-নিষেধ আরোপ করার পেছনে মূলত যে আশঙ্কা কাজ করছে তাহলো এই শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যবহার করে পশ্চিমা সংস্কৃতি আমাদের সমাজে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং আমাদের কন্যারা এমন এক পথে চালিত হয়ে পড়তে পারে, যা আমাদের ধর্ম ও মূল্যবোধের পরিপন্থী।
এ জন্যই যখন আমরা এজাতীয় সম্মেলনগুলোতে নারীশিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলি, তখন আমাদের অবশ্যই ইসলামী বিধান ও নির্দেশনাগুলোকেও পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে, বিশেষত নারীর সামাজিক ভূমিকা প্রসঙ্গে। এর মধ্যে হিজাবের বিষয়টিও রয়েছে, যেটিকে কিছু পশ্চিমা দেশে এমন অপরাধ হিসেবে দেখা হয়, যেন এটি কোনো কলঙ্ক বা লজ্জাজনক চিহ্ন।
আমাদের স্পষ্টভাবে বলতে হবে যে ইসলাম শুধু ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনকেই উৎসাহ দেয় না, বরং বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও অন্যান্য উপকারী জ্ঞান অর্জনেও মুসলিম নারীদের উৎসাহিত করে। তবে শর্ত এই যে নারীরা যেন প্রতিটি ধাপে ইসলামী আদর্শ ও নীতিমালার পূর্ণ অনুসরণ করে।
গাজার মাজলুম নারীরা তো বাঁচার অধিকারটুকুও হারিয়ে ফেলেছে
দ্বিতীয় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার প্রতি এই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে দৃষ্টি আকর্ষণ করা অপরিহার্য এবং যার প্রতি মাওলানা ফজলুর রহমান সাহেবও ইঙ্গিত করেছেন, তা হলো-আমরা এখানে মুসলিম নারীদের শিক্ষাবিষয়ক আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত রয়েছি, কিন্তু আমাদের সেই কন্যাদের কথাও স্মরণ রাখা উচিত, যাদেরকে শুধু শিক্ষার অধিকার থেকেই বঞ্চিত করা হয়নি, বরং যাদের কাছ থেকে জুলুম ও জবরদস্তির মাধ্যমে জীবনযাপনের মৌলিক অধিকারটুকুও ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।
আমাদের স্পষ্ট ভাষায় ইসরায়েলের বর্তমান কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলোর ব্যাপারে কথা বলা উচিত, কারণ এখন আর এই পরিকল্পনাগুলো কারো কাছেই গোপন নয়। সম্প্রতি ইসরায়েল একটি তথাকথিত মানচিত্র প্রকাশ করেছে, যাতে তারা জর্দান, সিরিয়া ও লেবাননের কিছু অংশকেও নিজের ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত দেখিয়েছে। বাস্তবে এটি তাদের পরিকল্পনার শুধু একটি ছোট ঝলক মাত্র, তাদের আসল অভিপ্রায় এর চেয়েও অনেক বেশি ভয়ংকর।
সুতরাং এই সম্মেলনের মাধ্যমে যেখানে বিশ্বের বাছাই করা আলেমরা একত্র হয়েছেন, আমাদের উচিত এই জায়নিস্ট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি সাহসী ও সুস্পষ্ট অবস্থান প্রকাশ করা।
আমরা সৌদি আরবের সেই অবস্থানকে প্রশংসার চোখে দেখি, যেখানে তারা প্রকাশ্যেই ইসরায়েলের এই মানচিত্রের তীব্র নিন্দা করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখনো কি সেই সময় আসেনি, যখন গোটা মুসলিম উম্মাহ ‘এক দেহ, এক প্রাণ’-এর বাস্তব রূপ ধারণ করে ঐক্যবদ্ধ হবে এবং সমগ্র ইসলামী বিশ্বকে গ্রাস করতে উদ্যত এই অত্যাচারী ও আগ্রাসী সাপের বিরুদ্ধে একটি কণ্ঠস্বর হয়ে দাঁড়াবে?
অতএব, এই সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলোতে ইসরায়েলের এই প্রকাশ্য ও নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত ও ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। সব শেষে আমি আপনাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আর আল্লাহ তাআলাই আমাদের সঠিক পথে চলার তাওফিক দানকারী।
বিডি প্রতিদিন/এমআই