ভোট যতই এগিয়ে আসছে, ততই যেন সুর পাল্টাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের। গত শনিবার কালীঘাটে নিজের বাড়িতে সভায় দলীয় কর্মীদের সংযত হতে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সোমবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুরে প্রশাসনিক সভায় উচ্চারণ করেননি একটিও রাজনৈতিক কথা। বিরোধীরা গত ক’দিনে শিল্পায়নের অভাব নিয়ে সরব হলেও সরাসরি কোনো প্রত্যাঘাতে যাননি। আর মঙ্গলবার উত্তর দিনাজপুরের গোয়ালপোখর দেখল অন্য এক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে! যে মুখ্যমন্ত্রী এর আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার দলের তাণ্ডবকে 'ছোট ছোট ছেলেদের ঘটিয়ে ফেলা' ঘটনা আখ্যা দিয়েছিলেন, তিনিই এ দিন বললেন, 'রাজনীতির কারণেই ছোট ঘটনাগুলো বড় আকার নেয়।'
রায়গঞ্জে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাণ্ডবের ঘটনায় বারবার জড়িয়েছে তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনের নাম। তাই মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের মন্তব্য নিজের দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি সতর্কবার্তা বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি, রাজনীতিকদের একটা বড় অংশের মতে, শাসক দলের রাজনীতিই যে ঘটনাগুলিকে বড় আকার দিয়েছে, সে কথাও কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন মমতা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরপর তাণ্ডবকে তিনি অতীতে যেভাবে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন, তা মানুষ মেনে নেয়নি। তাই তিনি অবস্থান বদল করেছেন।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা অবশ্য এ দিনও দাবি করেছেন যে, ঘটনাগুলো 'ছোট ছোট'। গোয়ালপোখরের সরকারি সভায় তিনি বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে টুকটাক গণ্ডগোল হতেই পারে। কিন্তু বড় আকার দিতে নেই। রাজনীতির কারণই বড় আকার দেয়।' সেইসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা দেন, 'শিক্ষায় রাজনীতি চলবে না।'
মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে ভরসা রাখছেন না বিরোধীরা। স্থানীয় সাংসদ, সিপিএমের মোহাম্মদ সেলিমের মতে, 'একে বোধোদয় না বলে ভারসাম্যের খেলা বলাই ভাল। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সিন্ডিকেট করলে দল থেকে বের করে দেওয়া হবে, কিন্তু তা রমরম করে চলছে। বিরোধীদের উপরে হামলা করতে বারণ করছেন, কিন্তু সে ঘটনা ঘটেই চলেছে। তাই ওই মন্তব্যে নিশ্চয়ই কোনো খেলা আছে।' বিজেপির বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেন, 'শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গোলমালকে বারবার ছোট ঘটনা বলে মুখ্যমন্ত্রী সমস্যাটি লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। আর তাতেই প্রশ্রয় পেয়ে রাজ্যের নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তৃণমূল গোলমাল করেছে।'
রায়গঞ্জে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণ্ডগোল শুরু হয়েছিল তৃণমূল ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মাথায়। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি তৎকালীন রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিলীপ দে সরকারকে কলেজ থেকে টেনে বার করে মারধর করে তৃণমূলের সাবেক কার্যকরী জেলা সভাপতি তিলক চৌধুরী এবং টিএমসিপির তৎকালীন জেলা পর্যবেক্ষক প্রিয়ব্রত দুবেসহ একদল নেতাকর্মী। তখন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, 'ছোট ছোট ছেলেরা এই ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে।'
এরপরে তিলক ও প্রিয়ব্রতর বিরুদ্ধে পুলিশ জামিনযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের করে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক অপূর্ব পালের অভিযোগ, 'মুখ্যমন্ত্রীর কথার সুরেই প্রশ্রয়ের ভাব ছিল। তাই প্রশাসনও কড়া হতে পারেনি।' ওই কলেজে গণ্ডগোলের অবশ্য বিরাম ঘটেনি। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরেও কখনো হাতাহাতি কখনো বা গুলি-বোমা নিয়ে সংঘর্ষ, বাদ পড়েনি কিছুই। গত অাগস্ট থেকে ডিসেম্বর টিএমসিপি-র বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে হামলার অভিযোগ জানিয়েছিল ছাত্র পরিষদ। পাশাপাশি, টিএমসিপিতে যোগ দিতে রাজি না হওয়ায় গত ১৮ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই বন্দুকের বাঁট দিয়ে মেরে ছাত্র পরিষদের এক সমর্থকের মাথা ফাটিয়ে দেওয়ারও অভিযোগ ওঠে।
রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া রায়গঞ্জের সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ও ইটাহারের কলেজেও একাধিক গণ্ডগোলে তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের নাম জড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এ দিনের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গোলমালের প্রসঙ্গ তোলেন। জেলায় শিক্ষার উন্নয়নের নানা খতিয়ান দেওয়ার সময়ে আচমকাই মমতা বলেন, 'কথা দিয়েছিলাম, রায়গঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয় করে দিয়েছি। প্রায় দেখি ছোট ছোট ঘটনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গন্ডগোল হচ্ছে। ভিসিকে বলব ব্যবস্থা করতে।' এর পরেই রাজনীতির কারণেই টুকটাক গন্ডগোল বড় আকার নেয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
একথা শুনে শমীকবাবু বলেন, 'মুখ্যমন্ত্রীর কথায় এখনো কিন্তু ঘটনাগুলো ‘টুকটাক’ বা ‘ছোট ছোট’, আসলে শতবার ধুলেও কয়লার কালি কি যায়!' সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকার
বিডি-প্রতিদিন/৩০ ডিসেম্বর ২০১৫/শরীফ