ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অভিন্ন নদীর পানি বন্টন সমস্যা দূরীকরণে জয়েন্ট বেসিন ম্যানেজমেন্ট অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। তাঁর অভিমত উভয় দেশের মধ্যে বেশ কিছু সমস্যার সমাধান হলেও কিছু সমস্যা এখনও নিশ্চয়ই আছে। এর মধ্যে নদীর পানি বন্টন সমস্যা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে পানির সমান ব্যবহারে জয়েন্ট বেসিন ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা খুবই প্রয়োজন। শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে প্রেসক্লাব অব নর্থ বেঙ্গল’এর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মোয়াজ্জেম আলী এসব কথা জানান।
দুই দেশের মধ্যে তিস্তার মতো বকেয়া চুক্তি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন ‘দুই দেশের মধ্যে যে সমস্যাগুলি আছে তার মধ্যে নদীর পানি বন্টন সমস্যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের (বাংলাদেশ) বছরে নয় মাস পানি বন্টনের দরকার হয় না। সৃষ্টিকর্তা যে পানি দেন তা যথেষ্ট কিন্তু বাকি তিন মাস খরা মৌসুমে নদীর ধারন ক্ষমতা কমে যায়। তখন অতি বর্ষণে বন্যা হয়, আবার বৃষ্টি না হলে খরার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে জয়েন্ট বেসিন ম্যানেজমেন্ট হিসাবে আমরা আমাদের নদীগুলিকে পরিমাপ করা দরকার। অর্থাৎ নদীর উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্বে থাকলে নদীগুলিকে তার জীবন ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব’।
নদীর ওপর একাধিক বাঁধ ও সেচ প্রকল্প নির্মাণ নিয়ে তিনি বলেন, ‘এই বাঁধ ও সেচ প্রকল্পগুলি বিজ্ঞানগত ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে ন্যায়সঙ্গত হয়নি, ফলে দুই দেশের পক্ষেই অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। অতএব আমরা যদি জয়েন্ট বেসিন ম্যানেজমেন্ট করতে পারি তবে এক সাথে বসে এই সমস্যার সমাধানের ব্যবস্থা করতে পারি’।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলছে বলেও মনে করেন এই কূটনীতিক। আলী বলেন ‘আমি অত্যন্ত খুশি যে বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক স্বর্ণযুগের বলে পরিগণিত হচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার ক্ষমতা গ্রহণের পর দুই দেশের মধ্যে আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন হয়েছে, দুই দেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের জন্য দুই দেশের মধ্যে যে রেল পথগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেগুলিকে পুনরায় চালু করা হয়েছে। দুইটি জায়গা বাকি রয়েছে, আগামীদিনে সেই দুইটি রেল পথও চালু করা হবে। সেই সাথে আগরতলা-আখাউড়া নতুন রেল সংযোগ স্থাপন করা হচ্ছে। এই রেল পথ হয়ে গেলে উত্তরপূর্বের সমস্ত রপ্তানি সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে যেতে পারবে। নৌ এবং উপকূলীয় পথেও ভারতের সাথে কানেকটিভিটি বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে। নদীপথে সংযোগ স্থাপন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ড্রেজিং করা হচ্ছে।
দুই দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধির দিকটি তুলে ধরে তিনি বলেন ‘একটা সময় দুই দেশের বাণিজ্য মিলিয়ন ডলারে ছিল এখন তা বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। চীনের পর বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক উৎপাদনকারী দেশ। ভারত থেকে তুলা কিনে তা দিয়ে কাপড় তৈরি করে বাংলাদেশ বিশ্বে রপ্তানি করে। ভারতের সাথে আগে এনার্জি কো-অপারেশন ছিল না। কিন্তু বর্তমানে থার্মাল পাওয়ার, হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার, নিউক্লিয়ার পাওয়ার, সোলার পাওয়ার-সব ক্ষেত্রেই পারস্পরিক সহযোগিতা রয়েছে। আমরা আশা করছি এই সহযোগিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে দ্রুততম ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দেশের মধ্যে অন্যতম। এর জন্য সর্বপ্রথমে ভারতকেই ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। কারণ বাংলাদেশের গৌরব ও উন্নতির অর্থই হল ভারতের উন্নতি। উভয় দেশের যে সম্পর্ক আমরা গড়ে তুলেছি-আমরা আশা করবো এই সম্পর্ক অন্য প্রতিবেশি দেশগুলির কাছেও রোল মডেল হয়ে থাকবে’।
সংবাদ সম্মেলন থেকে শিলিগুড়িতে বাংলাদেশ মিশন খোলার ব্যাপারেও আশ্বাস দিয়েছেন বাংলাদেশ হাইকমিশনার। তিনি বলেন ‘বর্তমানে ভারতে সর্বমোট পাঁচটি বাংলাদেশ মিশন রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে শিলিগুড়িতে আরেকটি মিশন খোলা যায়। এব্যাপারে ভারত সরকারের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে, আমাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দিয়েছি, ভারত সরকার যদি তাতে সম্মতি দেয় তবে অচিরেই শিলিগুড়িতে একটা ভিসা অফিস খোলা হবে। শিলিগুড়িসহ উত্তরবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের কানেকটিভিটি বাড়ানোর লক্ষ্যে বাগডোগরার সাথে ঢাকার বিমান সংযোগ স্থাপনের কথাও বলেন তিনি।
বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আগামী তিন মাসের মধ্যে সেদেশে বেশ কয়েকজন ভারতীয় মন্ত্রী পর্যায়ের সফর হবে বলেও জানান সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। তিনি বলেন, প্রথম দেড় মাসেই ঢাকা সফর করতে যাচ্ছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। ঢাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে তিনি বাংলাদেশ যাচ্ছেন। এরপর ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী সুরেশ প্রভু ঢাকায় যাবেন। পরবর্তীতে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিস বাংলাদেশ সফর করবেন।
বিডি প্রতিদিন/২৯ জুন ২০১৮/হিমেল