মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

জোটে থাকলেও ভোটে নেই

জোটের রাজনীতি ভোটের রাজনীতি বগুড়া

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

জোটে থাকলেও ভোটে নেই

কেন্দ্রীয়ভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪-দলীয় জোট থাকলেও বগুড়ার ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ একাই একশ। এ জেলায় জোটের কার্যক্রম কেন্দ্রীয় কর্মসূচির ওপর নির্ভর করে। তবে ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ একা। এখানে আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ছাড়া জোটের অন্য কোনো দলের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। তবে দু-একটি দলের রয়েছে প্যাডসর্বস্ব জেলা কমিটি।

২০০৮ সালের নির্বাচনে বগুড়ার দুটি আসনে নৌকার প্রার্থীরা বিজয়ী হয়ে বিএনপির দুর্গে আঘাত হানে। সেই থেকে জেলার অন্য উপজেলাতেও সংগঠনে চাঙ্গা ভাব দেখা যায়। সর্বশেষ বিএনপিবিহীন ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি চারটি আসনে, আওয়ামী লীগ দুটিতে ও জাসদ একটিতে বিজয়ী হয়। সম্প্রতি সমাপ্ত হওয়া পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনের অধিকাংশেই আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা বিজয়ী হন। জেলার ১২ পৌরসভার মধ্যে ছয়টিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। একই সঙ্গে জেলার ১০৮টি ইউনিয়নের মধ্যে প্রায় ৬০টিতে নৌকার প্রার্থীরা জয়ী হন। এসব ভোটে আওয়ামী লীগ এককভাবে প্রার্থী দিলেও ১৪-দলীয় জোটের কোনো প্রার্থী দেখা যায়নি। তবে দু-একটি পৌরসভা ও ইউনিয়নে মশাল প্রতীক নিয়ে জাসদের প্রার্থী থাকলেও অন্য কোনো দলের প্রার্থীদের দেখা যায়নি। সে ক্ষেত্রে ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এককভাবে প্রার্থী নির্বাচন ও ভোট করেছে। সেখানে জোটের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। এদিকে জেলা জাসদ সভাপতি রেজাউল করিম তানসেন বগুড়া-৪ আসনের এমপি থাকায় ওই দুই উপজেলায় জাসদের কমিটি রয়েছে। শহরসহ অন্যান্য উপজেলায়  কমিটি থাকলেও তেমন কার্যক্রম নেই। ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা কমিটি থাকলেও কোনো উপজেলায় সাংগঠনিক তত্পরতা নেই। এ কারণেই ১৪-দলীয় জোট থাকলেও ভোটের ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব না থাকায় আওয়ামী লীগ ভোটের রাজনীতিতে একক কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে বলে সচেতন মহলের ধারণা। বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মজিবর রহমান মজনু জানান, আওয়ামী লীগ বিগত যে কোনো সময়ের তুলনায় বগুড়ায় শক্তিশালী। বিগত ইউপি ও পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা ভালো ফল করেছেন। এ ছাড়া ১৪-দলীয় জোট বগুড়ায় সক্রিয় রয়েছে। জোটের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি জোটবদ্ধভাবে পালন করা হয়ে থাকে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়ায় নৌকার প্রার্থীরা আরও ভালো ফল করবেন বলে তিনি জানান। এদিকে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কার্যক্রম বগুড়ায় চলছে ঢিমেতালে। চারটি সংসদীয় আসনে এমপি থাকলেও স্থবিরতা নেমে এসেছে দলীয় কর্মকাণ্ডে। সদর উপজেলা ছাড়া অন্যান্য উপজেলা কমিটির নেতা-কর্মীরা প্রায় নিষ্ক্রিয়। জানা গেছে, বগুড়া সদর ছাড়া অন্য আসনে এমপিরা সব কর্মকাণ্ডে দলীয় নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে স্বজনদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এতে করে দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতা-কর্মীরা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরে যান। সম্প্রতি শেষ হওয়া ইউপি নির্বাচনে জাপার কোনো প্রার্থীই বিজয়ী হতে পারেননি। শিবগঞ্জে জাপার এমপি থাকলেও লাঙল প্রতীক নিয়ে ভোট করে পাঁচ ইউপির চেয়ারম্যান প্রার্থীই জামানত হারিয়েছেন। বগুড়া সদর ছাড়া অন্যান্য উপজেলায় দলীয় ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নেতা-কর্মীদের সংশ্লিষ্টতা না থাকায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন নেতা-কর্মীরা। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব ও বগুড়া জেলা সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম ওমর এমপি জানান, সম্প্রতি জেলার সম্মেলন সম্পন্ন হয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন শক্তিশালী করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

২০-দলীয় জোট কাগজে-কলমে : কাগজে-কলমে ২০-দলীয় জোট থাকলেও বগুড়ায় বাস্তবে নেই কোনো কার্যক্রম। রাজপথের কর্মসূচি দূরে থাক, জোটের কোনো সভাও হয়নি দুই বছরে। ভোটের রাজনীতিতে ২০-দলীয় জোট এখন নামে মাত্র। বিএনপি ঘরোয়া কর্মসূচিতেই সীমাবদ্ধ রেখেছে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম। জোটের প্রধান শরিক জামায়াত মামলায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান হিসেবে বগুড়াকে বিএনপির দুর্গ হিসেবে এখনো ধরা হয়। এ ছাড়া বিএনপি জোটের প্রধান শরিক জামায়াতে ইসলামীর বড় ভোটব্যাংক  রয়েছে এই বগুড়ায়। তাই  ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী জোটের সামনে বিএনপি জোটের পাল্লাই ভারী বলে এখনো মনে করেন রাজনীতি-সচেতনরা। তবে বিগত পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনে জোটবদ্ধ ভোট হয়নি বগুড়ায়, যার কারণে জেলার অধিকাংশ পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। বগুড়ায় সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে বিপর্যস্ত বিএনপি-জামায়াত জোট এখন মাঠের রাজনীতিতে অনেকটাই কোণঠাসা। এ জোটের জেলা পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অধিকাংশ নেতা-কর্মী মামলা মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। ফলে রাজনীতির মাঠ থেকে তারা এখন অনেক দূরে। সর্বশেষ ২০১৫ সালে প্রায় তিন মাসের অবরোধ কর্মসূচিতে জোটগত কর্মসূচি পালন করে তারা। তবে এরপর গত দুই বছরে জোটগত কোনো কর্মসূচি নেই। রাজনীতির মাঠে বিএনপি দলীয় কর্মসূচি পালন করছে। তবে জোটের কোনো শরিক দল মাঠে নেই। অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে আদালতের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মাঝেমধ্যে রাজপথে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে। এ ছাড়া কোনো কর্মসূচি চোখে পড়ে না। ফলে এ মুহূর্তে বগুড়ায় জোটের রাজনীতি নেই। এদিকে জোটের যেমন অস্তিত্ব নেই, তেমনি নেই ভোটের রাজনীতি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটগত নির্বাচন হয়েছে। এরপর দশম সংসদ নির্বাচন হলেও অংশ নেয়নি বিএনপি জোট। তবে বিগত সময়ে স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদের দুই দফা নির্বাচন হলেও সেখানে জোটগত প্রার্থী ছিল না।  বিএনপি ও জামায়াত আলাদা নির্বাচন করেছে। বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলাম জানান, মামলার কারণে অনেক নেতা-কর্মী ঘরছাড়া। তবে সাংগঠনিকভাবে বিএনপি বিগত সময়ের মতো এখনো শক্তিশালী। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বগুড়ার সাতটি আসনেই বিএনপির প্রার্থীরা বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন। জনগণ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে তাদের ভোট ধানের শীষের বাক্সেই যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

কর্মী সংকটে বামদল : একসময় রাজপথে বিভিন্ন ইস্যুতে সক্রিয় থাকলেও ক্রমেই স্থিমিত হয়ে যাচ্ছে বাম সংগঠনগুলোর কার্যক্রম। তেল,গ্যাস, বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা ছাড়া আর কোনো কর্মসূচিতে তাদের দেখা যায় না। বাসদ ও সিপিবি বগুড়ায় মাঝে মধ্যে মিছিল সমাবেশ করলেও জনসম্পৃক্ততা নেই। গুটিকয় নেতা-কর্মী নিয়েই তাদের কার্যক্রম। এ ছাড়া আ স ম রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডি ঘরোয়াভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বাম সংগঠনগুলো। বাসদ, সিপিবি, জেএসডিসহ অন্য দলগুলো কোনোমতে টিকিয়ে রেখেছে তাদের কার্যক্রম। কর্মীসংখ্যা বেশি না থাকলেও কেন্দ্রীয় ঘোষিত কর্মসূচি পালন করছে নিয়মিত। বর্ষীয়ানরা সরে গেছেন আর সেই পদ আগলে ধরেছেন নতুনরা। বিশেষ করে বাসদের দুই ভাগেরই ছাত্র সংগঠন ছাত্রফ্রন্ট বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দাবি নিয়ে বগুড়ায় মিছিল-সমাবেশের মাধ্যমে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। সরকারি আযিযুল হক কলেজ ছাড়া আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের কার্যক্রম চোখে পড়ে না। একসময় জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ইউনিয়নের রমরমা অবস্থা থাকলেও এখন তাদের কোনো কার্যক্রম আর দেখা যায় না। সব মিলিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লড়াই করছে বাম দলগুলো। সাংগঠনিক তত্পরতা থাকলেও দলগুলোর কর্মীসংখ্যা বাড়েনি।

এমন অবস্থার মধ্যেই এসব দল স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। তবে ফলাফল হতাশাজনক। সাম্প্রতিক কালে উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে হাতে গোনা কিছু আসনে প্রার্থী দিলেও তারা কাঙ্ক্ষিত ফল ঘরে তুলতে পারেননি। তবে জনগণের সমস্যা নিয়ে মাঠে সরব থাকায় সাধারণ মানুষ তাদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেন। জেএসডির জেলা সাধারণ সম্পাদক রেজাউল বারী দীপন জানান, শাসন প্রশাসন পদ্ধতি পরিবর্তন না করে শুধু সরকার পরিবর্তনে সমস্যার সমাধান হবে না। জেএসডি জনগণের কল্যাণের চিন্তা করেই রাজনীতি করে। বগুড়ায় সাংগঠনিক অবস্থা আগের চেয়ে ভালো বলে তিনি জানান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর