বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

জোট-মহাজোট ‘নামকাওয়াস্তে’

জোটের রাজনীতি ভোটের রাজনীতি - ময়মনসিংহ

সৈয়দ নোমান, ময়মনসিংহ

জোট-মহাজোট ‘নামকাওয়াস্তে’

শুধু কেন্দ্রেই জোট-মহাজোট। ময়মনসিংহে জোট-মহাজোটের সিংহভাগ শরিক দলের নেই কোনো অস্তিত্ব। এমনকি কার্যালয়ও নেই বেশিরভাগ দলের। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দলের মর্যাদা হারানো বিএনপি ছাড়া মাঠে বিচরণ আছে হাতেগোনা তিন কী চারটি দলের। ভোট রাজনীতিতেও কাগুজে উভয় জোট। নির্বাচনেও ‘একলা চল নীতি’। হতাশায় নামমাত্র জোট ভাঙার আওয়াজ উঠছে ২০-দলে। বিপরীতে নির্ভার স্থানীয় মহাজোটের শীর্ষ নেতারা।

ঐক্য থাকলেও অস্তিত্বহীন ১৪-দলীয় জোট : ময়মনসিংহে ১৪-দলীয় জোটে ঐক্য থাকলেও এ জোটটিই মূলত অস্তিত্বহীন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন এ জোটে জাসদ আর ওয়ার্কার্স পার্টি ছাড়া অন্য দলগুলোকে রাজপথে খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। ফলে এ জোটের কার্যক্রমও কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। এতে করে জোটের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে দলের অন্দরে-বাইরে। জানা যায়, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলের নেতাদের সম্পর্ক মধুর। দেশব্যাপী সন্ত্রাস ও জঙ্গি হামলার পর কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়ে জোটের নেতা-কর্মীরা। একসঙ্গে তারা মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করে। এ ছাড়া জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতেও তারা একসঙ্গে সভা করে মাঠে আলাদা আলাদা কর্মসূচি পালন করে।

দলীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ ছাড়া মাঠে অস্তিত্ব রয়েছে শুধু জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ)। দলীয় সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সাদিক হোসেন সাংগঠনিকভাবে নড়বড়ে জাসদকে শক্তিশালী করে তুলতে মাঠে কাজ করছেন। প্রথমবারের মতো গত ইউনিয়ন পরিষদ  নির্বাচনেও বেশ কয়েকটি এলাকায় প্রার্থী দিয়েছে জাসদ। আর জোটের অন্য দলগুলোর প্রার্থিতার কোনো খবর পাওয়া যায়নি। জাসদের বাইরে ওয়ার্কার্স পার্টির কমিটি থাকলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কারণ হিসেবে দলটির সাধারণ সম্পাদক সুজিত বর্মণ বলছেন, ‘১৪ দল নামে মাত্র। ইগো সমস্যা হলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আ.লীগ। আমাদের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জোটগতভাবে একটি কর্মসূচি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে আমরা কোনো সাড়া পাইনি। পরে আমরা নিজেরাই করেছি। আর বর্তমানে ময়মনসিংহের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ১৪ দলের কোনো কার্যক্রম নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো তদবির করি না। রাজনৈতিক কারণে মতিউর রহমান স্যারকে ফোন করলে রিসিভ করেন না। এমনকি তার এপিএসও ফোন ধরেন না। এটি খুব দুর্ভাগ্যজনক। তবে আমাদের কর্মসূচি চলছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে আমরা পাঁচটি থানায় প্রার্থী দিব।’ ‘২৩ দফার ভিত্তিতে ১৪ দল তথা আ.লীগের সঙ্গে আমরা আছি। এর বাইরে দেশের স্বার্থে আমরা সরকার বিরোধী আন্দোলনও করি। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধিতাও করি আমরা’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। আ.লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাপ ছাড়া ১৪ দলে থাকা আরও কয়েকটি দলের নাম জানা গেছে। এগুলো হলো— সাম্যবাদী, বাসদ, কৃষক শ্রমিক সমাজবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র ও গণআজাদী লীগ। এ দলগুলোর কোনো জেলা কমিটি নেই। আর অনেক চেষ্টা করেও বাদ বাকি দলগুলোর নামই জানাতে পারেননি জোটের শীর্ষ কোনো নেতাই। এ ব্যাপারে জেলা জাসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, ‘ময়মনসিংহে বেশিরভাগ দলের সাংগঠনিক অস্তিত্বই নেই। এরপরেও ১৪ দলের ব্যানারেই আমরা আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছি। যারাই আছে তাদের নিয়েই আমরা জাতীয় এবং স্থানীয় কর্মসূচি পালন করি।’ সূত্র মতে, ১৪ দলের রাজনীতিতে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক, জেলা আ.লীগের সাবেক সভাপতি ধর্মমন্ত্রী প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামল থেকেই এখন পর্যন্ত ১৪ দলের ঐক্য ধরে রেখেছেন তিনি। তবে সম্প্রতি জেলা আ.লীগের কমিটি বিলুপ্ত করায় জোটের গাঁটছড়ায় কিছুটা হলেও চিড় ধরেছে বলে মনে করেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।

তবে জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সাদিক হোসেন বলেন, ১৪ দলের রাজনীতিতে ঐক্যের প্রতীক প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান। জোটের বন্ধন অটুট রেখে লড়াই-সংগ্রামে তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার নেতৃত্বে ১৪ দলের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ।

এদিকে, নির্বাচন কেন্দ্রিক মহাজোটেরও কোনো অস্তিত্ব নেই ময়মনসিংহে। মূলত জাতীয় পার্টির অনাগ্রহেই মহাজোটগতভাবে ময়মনসিংহে কোনো কর্মসূচি পালনেরও নজির নেই। তবে জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিবদমান দুই পক্ষের নেতা প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান ও ময়মনসিংহ পৌরসভার মেয়র ইকরামুল হক টিটুর সঙ্গে সখ্য রয়েছে জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতাদের। মহাজোটের বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও ১৪ দলের ঐক্যের বিষয়ে জেলা ১৪ দলের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়ক ও জেলা আ.লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মজিবুর রহমান মিল্কি জানান, ময়মনসিংহে ১৪ দলের যে কটি শরিক দল রয়েছে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো। যখনই প্রয়োজন তখনই সমন্বয় সভা ডাকা হয় আ.লীগ কার্যালয়ে অথবা সুবিধাজনক কোনো স্থানে। আর জোটের সমন্বয়ক হিসেবে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করছেন প্রবীণ রাজনীতিক প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান।

ময়মনসিংহে ছন্নছাড়া ১৮ দল : ২০ দলের মধ্যে বিএনপি বাদে কমিটি আছে মাত্র দুই দলের। বাকি ১৭ দলের ন্যূনতম অস্তিত্ব নেই ময়মনসিংহে। ভগ্নাংশ দলগুলোর নেতা কারা এমনটি জানেন না জোটের নেতৃত্বাধীন দল বিএনপির শীর্ষ নেতারা। গত বছরের শেষের দিকে তিন দল নিয়ে একবার ২০ দলের সভা হয়েছে কি হয়নি এ নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে বিএনপি জামায়াতের পরিমণ্ডলে। অকার্যকর জোটের নামটিই ক্রমে বোঝা হয়ে উঠছে বিএনপি-জামায়াতের কাছে। দ্রুত কার্যকর না হলে এ জোট ভেঙে দেওয়াই শ্রেয় এমন মত দল দুটির। সর্বশেষ কবে ২০-দলীয় জোটের বৈঠক হয়েছে তা জানেন না খোদ ময়মনসিংহ (দক্ষিণ) জেলা বিএনপির সভাপতি একেএম মোশাররফ হোসেন। পদাধিকার বলে জোটের সমন্বয়কের দায়িত্ব তার পালন করার কথা থাকলেও তিনি নিজেই এ দায়িত্ব অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু দলের সভাপতি। জোটের সমন্বয় আমার দায়িত্ব নয়। এ বিষয়টি কেন্দ্রই দেখভাল করে।’ তবে জেলা বিএনপির একটি সূত্র বলছে, গত পাঁচ বছরে জোটের সভা হয়েছে একটি। আর সেটি হয়েছে মোশাররফ হোসেনের বাসাতেই। সেখানে শুধু জামায়াত ও জাগপার প্রতিনিধি ছিলেন। দলীয় একটি সূত্র জানায়, ২০-দলীয় ঐক্যজোটের ‘মৌখিক’ সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন একেএম মোশাররফ হোসেন। আর সেকেন্ড ম্যান হিসেবে রয়েছেন জেলা জামায়াতের অধ্যাপক আমির জসিম উদ্দিন। যুদ্ধাপরাধ ও নাশকতা ইস্যুর পর ধর্মাশ্রয়ী দলটি প্রকাশ্যে আসে না বললেই চলে।

এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জসিম উদ্দিন জোটের নাজুক পরিস্থিতির জন্য দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি মোশাররফ হোসেনের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে বলেন, স্থানীয়ভাবে বিএনপির সঙ্গে আমাদের কোনো সমন্বয় নেই। এমনকি জেলা বিএনপির সভাপতি আমাদের কোনো খোঁজখবরও রাখেন না। আমাদের চরম দুঃসময়েও বিএনপিকে পাশে পাচ্ছি না। পেলে আমরা স্থানীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম আরও গতিশীল হতো। জসিম উদ্দিনের সঙ্গে একমত পোষণ করে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দ বলেন, জোটগতভাবে যিনি সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেন তিনি এ বিষয়ে অনেকটাই উদাসীন। এজন্য গত পৌরসভা ও সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে শুধু সমন্বয়হীনতার কারণে জোটের দলগুলো যে যার মতো প্রার্থী দিয়েছে। তাই, ভোটের ফলও জোটের অনুকূলে আসেনি। তিনি বলেন, ‘সমন্বয়হীনতার অভাবে সব দলের মাঝে এখন গা-ছাড়া ভাব। কঠিন সময়ে তাদের অনুপস্থিতি আন্দোলনে কিছুটা হলেও ক্ষতি হচ্ছে। তবে জোটগতভাবে ছোট-বড় দলের সমন্বয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমেই ভোটবিহীন এ সরকার হটানো সম্ভব।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর