সোমবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ঢাকার প্রাণ রমনা পার্ক

মোস্তফা কাজল

ঢাকার প্রাণ রমনা পার্ক

মেগাসিটি ঢাকার ‘ফুসফুস’ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে রমনা পার্ক। ঘন ঘাস, লতাগুল্ম, ছোট ও মাঝারি গাছ, মৌসুমি ফুলে সমৃদ্ধ এটি ঐতিহ্যবাহী পার্ক। এখানে অতি দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ যেমন রয়েছে, তেমন রয়েছে অচেনা পাখির কলকাকলিতে প্রশান্তি খুঁজে পাওয়ার সুযোগ। অট্টালিকাবদ্ধ এই রাজধানীতে প্রায় দেড় কোটি মানুষের বাস। ওয়াকিবহালদের মতে, যে হারে মানুষ রাজধানীমুখী হচ্ছে, তাতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। অথচ জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যধিক হওয়া সত্ত্বেও রাজধানীর কোথাও দম ফেলার তেমন ফুরসত নেই। কোথাও এতটুকু ফাঁকা জায়গা, একটু নির্মল বাতাস কিছুই নেই। তাই রাজধানী ঢাকার অন্যতম একটি বিনোদন কেন্দ্র ও মুক্ত জায়গা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে রমনা পার্ক। কোনোভাবেই যেন সাধারণ মানুষের অবসরযাপনের এ জায়গাটি নষ্ট না হয় এবং যথাযথ পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখা হয়, সে ব্যাপারে সোচ্চার পরিবেশবাদীরা। তাদের কথা, যে করেই হোক রমনা পার্ক রক্ষা করতে হবে। কারণ এরই মধ্যে মহানগরীর বেশির ভাগ মাঠ ও পার্ক বেদখল হয়েছে। সাধারণ মানুষের বেড়ানো ও শরীরচর্চার স্থান সংকুচিত হয়ে এসেছে। তাই রমনা পার্ককে দেশের একটি অনন্য উদাহরণ হিসেবে অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। অভিযোগ রয়েছে, রমনা বটমূল ছাড়া পার্কজুড়ে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কারণে ক্ষতি হচ্ছে এর জীববৈচিত্র্য। অব্যাহতভাবে নানা কনস্ট্রাকশন বিনষ্ট করছে সবুজ অঙ্গনকে। ফুলজ ও নান্দনিক গাছের বদলে বনজ ও ফলদ গাছের বিস্তার বাড়ছে; যা এ পার্কের সৌন্দর্য, উপযোগিতা ও ঐতিহ্যকে ব্যাহত করছে। যদিও সব উন্মুক্ত স্থান ও এর লনে পরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানো হচ্ছে। জাতীয় ফুল শাপলাসহ বিভিন্ন জলজ ফুল শোভা পাচ্ছে লেকে। রমনা লেকটি জলজ ফুল দিয়ে শোভিত করায় দেশের ঐতিহ্য ও এখানকার জীববৈচিত্র্য অনেকটা রক্ষা করছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া পার্কের শতবর্ষী ও ঐতিহ্যবাহী গাছগুলোরও যথোপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। সূত্রমতে, দেশজ ঐতিহ্যবাহী নান্দনিক ও ফুলজ গাছ রমনা পার্কে রোপণ করায় প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা পাচ্ছে। এতে পার্ক হিসেবে রমনা আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। সূত্রমতে, শহরের পরিবেশ দূষণ, বায়ূদূষণ, শব্দদূষণ ও জনসংখ্যার চাপে রাজধানী ঢাকা এখন বিশ্বের বসবাস অনুপযোগী শহরগুলোর অন্যতম। ইট-পাথরের এই শহরে নির্মল বাতাস পাওয়া দুষ্কর। পরিবেশবাদীরা এজন্যই রমনা পার্কের নাম দিয়েছেন রাজধানীর ফুসফুস।

পার্কের ইতিকথা : রমনা পার্ক শুধু ঢাকা শহরের নয়, বরং বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী একটি পার্ক। এটি বর্তমানে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন রয়েছে। পার্কের বর্তমান আয়তন ৬৮ দশমিক ৫ একর। এর লেকের আয়তন ৮ দশমিক ৭৬ একর। ১৬১০ সালে ঢাকায় মোগলদের শাসন পাকাপোক্ত হওয়ার পর বাগানের অনুরাগী মোগলরা এ উদ্যান তৈরি করেছিলেন। তখন এর নাম ছিল বাগ-ই-বাদশাহি। এখনকার ইস্কাটন থেকে নীলক্ষেত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সচিবালয় পুরো এলাকাই ছিল রমনা পার্কের চারপাশে। কোম্পানি আমলে রমনার দক্ষিণের একটি অংশে রেসকোর্স প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস। একপর্যায়ে ঢাকা থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হলে রমনা এলাকা ক্রমে জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে। মোগল আমলে গড়ে ওঠা রমনা উদ্যান মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে তার সৌন্দর্য হারায়। ঔপনিবেশিক যুগে (১৮২৫ সালে) ঢাকার ইংরেজ কালেক্টর মি. ডস ঢাকা নগরীর উন্নয়নে পদক্ষেপ নেন এবং কারাগারের বন্দীদের দিয়ে রমনার জঙ্গল পরিষ্কার করে বের করেন ডিম্বাকৃতির একটি অংশ। পরিষ্কার করা অংশটিকে কাঠের রেলিং দিয়ে ঘিরে তৈরি করা হয় রেসকোর্স। ইংরেজদের আমলে এই রেসকোর্সের উত্তর-পশ্চিমে একটি টিলাঘর তৈরি করে চারপাশে লাগানো হয় গাছ-গাছালি। এই রেসকোর্সকে কেন্দ্র করেই আবার রমনার আভিজাত্য ফিরে আসে। ১৮৪০ সালের দিকে বিত্তবানেরা এ এলাকায় বাগানবাড়ি করতে থাকেন। পরে নবাব আবদুল গনি এসব বাগানবাড়ির মধ্য থেকে অবসরপ্রাপ্ত জজ জন ফ্রান্সিস গ্রিফিথের বাড়িটি কিনে নেন। এলাকাটিকে তারাই উন্নত করে নাম দেন শাহবাগ। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর মোগলদের রমনা তিন ভাগ হয়ে যায়। নবাবদের মালিকানায় থাকে শাহবাগ এলাকা। উত্তর দিকে মিন্টো রোডে হয় সিভিল স্টেশন নামে সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসিক এলাকা। মাঝখানে রেসকোর্স ও বর্তমানের রমনা উদ্যান মিলিয়ে হয় রমনা এলাকা। রেসকোর্সে পাকিস্তান আমলেই আইন করে ঘোড়দৌড় বন্ধ করে দেওয়া হয়। বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান একসময় রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিল। ১৬১০ থেকে ১৮২৪ সাল পর্যন্ত এর নাম ছিল বাগ-ই-বাদশাহি বা বাদশাহি বাগান। ১৯২৫ সালে এ স্থানটি ঘোড়দৌড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। তাই এর নাম হয় রেসকোর্স ময়দান। ১৯৭১ সালে এর নামকরণ হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ১৯৯৬ সালে এখানে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শিখা চিরন্তন স্থাপন করা হয়। ১৯৯৯ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণকাজ শুরু হয়, যা শেষ হয় ২০১৫ সালে।

বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (বাপা)-এর সম্পাদক ডা. আবদুল মতিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রমনা পার্ক ঢাকা শহরের অনন্য একটি পার্ক। হাঁটাচলা, বেড়ানোর পাশাপাশি বৃক্ষ চেনার জন্যও এখানে অনেকে আসেন।’ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে এবং ওই কমিটির সুপারিশের আলোকে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে উন্নয়ন পদক্ষেপ নিলে রমনা পার্ক রক্ষা করা ও এর ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর