রবিবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সম্পর্কে নতুন মাত্রা আনল ট্রান্সশিপমেন্ট

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্, আশুগঞ্জ থেকে ফিরে

বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সম্পর্কে নতুন মাত্রা আনল ট্রান্সশিপমেন্ট

প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে ট্রান্সশিপমেন্ট কার্যক্রম চালু হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। আর এতে বাণিজ্যে সুফল পাওয়া যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। গত বছরের জুনে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রানশিপমেন্টের উদ্বোধনের পর দেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌবন্দর আশুগঞ্জ এখন নানাভাবে পাল্টে যাচ্ছে। দুই দেশের ট্রান্সশিপমেন্টকে কেন্দ্র করে স্থানীয়   ব্যবসায়ীরা নানা ধরনের ব্যবসা করার পরিকল্পনা এঁটেছেন। নৌবন্দর আশুগঞ্জে গড়ে উঠছে উন্নতর সুযোগ-সুবিধা সংবলিত হোটেল, রিসোর্ট ইত্যাদি। অবকাঠামোর দিক দিয়েও ব্যাপক উন্নয়ন শুরু হয়েছে। নতুন করে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন এখানকার শ্রমিকরা। ইতিমধ্যে স্থাপন করা হয়েছে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কনটেইনার টার্মিনাল। এই টার্মিনাল দিয়েই ভারতের পূর্বের ‘সেভেন সিস্টারস’ অর্থাৎ আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল রাজ্যের প্রয়োজনীয় পণ্য জাহাজ থেকে নামানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ট্রান্সশিপমেন্টকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে তোলা হচ্ছে উচ্চতর প্রযুক্তি নির্ভর আইসিটি কনটেইনার টার্মিনাল। আর এসব ঘিরে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি এখন যেন সময়ের ব্যাপার। লেনদেনের জন্য গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের শাখাও। অনেকটা ব্যস্ত শহরে পরিণত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ। শুধু তাই নয়, ট্রান্সশিপমেন্ট ঘিরে আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত ৪৫ কিমি সড়কটিও করা হবে চার লেনে উন্নীত। সড়কের দুই পাশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ব্যবসায়ীরা জমি কিনে প্রতিষ্ঠান গড়তে ব্যস্ত। আশুগঞ্জ নৌবন্দর পরিদর্শক শাহ আলম বলেন, দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকলে দেশের বাণিজ্যিক উন্নয়ন হবে। এখন এই নৌবন্দর দিয়ে ভারতে যাচ্ছে রড, টিন, চাল ও আগরতলায় নির্মিতব্য বিদ্যুেকন্দ্রের নানা সামগ্রী। এখানকার ব্যবসায়ীরা জানান, ঝিমিয়ে পড়া আশুগঞ্জ নৌবন্দর এখন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। এক সময় দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ নৌবন্দরটি অনেক ব্যস্ত ছিল। কিন্তু নানা কারণে এ ব্যস্ততা কমে যায়। এখন ট্রান্সশিপমেন্টের কারণে কর্মচঞ্চল হয়েছে আশুগঞ্জ। জানা গেছে, আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার করে স্থায়ীভাবে ট্রান্সশিপমেন্ট কার্যকরের আগ্রহ দেখিয়ে আসছিল ভারত। দীর্ঘ আলোচনার পর ভারতের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের জুনে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় একটি চুক্তি হয়। পরে নয়াদিল্লিতে সচিব পর্যায়ের বৈঠকে মাশুল নির্ধারণের বিষয়টিও চূড়ান্ত করা হয় ওই বছরের নভেম্বরে। বৈঠকে সমঝোতার ভিত্তিতে নৌ ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় মাশুল বা ফি নির্ধারণ করা হয় টনপ্রতি ২৭৬ টাকা ২২ পয়সা। এরমধ্যে প্রতি মেট্রিক টনে স্কট ফি ও শুল্ক ১৮০ টাকা পাবে বাংলাদেশের শুল্ক কর্তৃপক্ষ। সড়ক বিভাগকে প্রতি টনে দেওয়া হবে ৫২ টাকা। আর ল্যান্ডিং অ্যান্ড শিপিং চার্জ হিসেবে ৪৪ টাকা দেওয়া হবে বিআইডব্লিউটিএকে। মাশুল নির্ধারণের পর গত বছরের ১৬ জুন দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের উপস্থিতে ট্রান্সশিপমেন্ট কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। আনুষ্ঠানিক ট্রান্সশিপমেন্ট কার্যক্রম উদ্বোধনের পর আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার করে এ পর্যন্ত তিন দফায় মাশুল দিয়ে ১ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন রড, ২ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন চাউল যায় ভারতে। এর আগে আশুগঞ্জ বন্দরকে ‘পোর্ট অব কল’ (ট্রানশিপমেন্ট পয়েন্ট) ঘোষণা করে সরকার। নৌ প্রটোকলের আওতায় কলকাতা-আশুগঞ্জ-আখাউড়া-আগরতলা পথে মাশুল ছাড়াই পরীক্ষামূলকভাবে ভারত সরকারের বিশেষ অনুরোধে মাশুলবিহীন বাংলাদেশ সরকার মানবিক কারণে অনুমতি দেওয়ায় লোহা, চাউল ও বিদ্যুেকন্দ্রে ভারী যন্ত্রাংশসহ অন্তত ৩০ হাজার মেট্রিক টন মালামাল নেয় ভারত। বন্দরের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্রান্সশিপমেন্ট কার্যক্রম চালু হওয়ায় অনেক খুশি তারা। তবে ব্যবসায়ীরা বলেন, বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি। সরজমিনে দেখা যায়, আশুগঞ্জ নৌবন্দরের পুরাতন ফেরিঘাটে বানানো হয়েছে একটি কনটেইনার টার্মিনাল। আর এই টার্মিনাল থেকে মহাসড়কে যাওয়ার সড়কটুকু উচ্চ লোড ধারণসম্পন্ন করে নির্মাণ করা হয়েছে। টার্মিনালের পাশেই রয়েছে ওয়্যারহাউজ, পার্কিং ইয়ার্ড। ট্রানশিপমেন্টকে ঘিরে দেখা যায়, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের ব্যাপক কর্মব্যস্ততা। তবে সিলেট মহাসড়কের বিশ্বরোড মোড় থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত সড়কের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আখাউড়া পর্যন্ত সড়ক মোটামুটি ভালো। এদিকে ব্যবসায়ীরা বলেন, যে ঘাটে ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্যবাহী জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করা হচ্ছে সেই ঘাটে আগে তারা পণ্য খালাস করতেন। এতে করে দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে তাদের। তাই তারা চান, ট্রান্সশিপমেন্টের জাহাজ বিকল্প কোনো স্থানে বড় পরিসরে নোঙ্গর করুক স্থানীয়ভাবে নিয়োগকৃত পরিবহন ঠিকাদারও শ্রমিকদের ন্যায় মুজরি দিচ্ছে না। এ ছাড়া স্থানীয় ট্রাকে করে মাল নিয়ে যাওয়ার কথা ঢাকা থেকে কাভার্ড ভ্যান ভাড়া করে এনে মাল পরিবহন করা হচ্ছে। এতে করে স্থানীয় ট্রাক মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

আশুগঞ্জ শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি গোলাম হোসেন ইপটি দ্রুত অবকাঠামো উন্নয়ন শুরু করার দাবি জানান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার মো. কামরুল ইসলাম জানান, ইতিমধ্যে আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করে ৩ দফায় প্রায় ৪ হাজার ২৬১ মেট্রিক টন মালামাল ভারতে গেছে। আর এসব পণ্য থেকে ১২ লাখ টাকারও বেশি রাজস্ব পাওয়া গেছে। খুব শিগগিরই আরও পণ্য আসছে। এর পরিধি আরও বাড়বে। নৌমন্ত্রী শাজাহান খান জানান, আশুগঞ্জ বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য খুব শিগগিরই জমি অধিগ্রহণ করার চেষ্টা চলছে। আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ত্রিপুরায় পণ্য পৌঁছানোর দায়িত্ব পাওয়া সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট জলি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. মোবারক হোসেন ভূইয়া জানান, ত্রিপুরায় পণ্য পাঠাতে ৬০টি খোলা ট্রাক ব্যবহার করা হচ্ছে।

 

সর্বশেষ খবর