মঙ্গলবার, ২২ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গাদের শূন্যরেখা ছাড়তে মিয়ানমারের হুমকি অব্যাহত

ফারুক তাহের, তুমব্রু, নাইক্ষ্যংছড়ি (বান্দরবান) থেকে

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু শূন্যরেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সরে যেতে মাইকিং ও হুমকি অব্যাহত রেখেছে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। এ ছাড়া শূন্যরেখার জমিগুলো নিজেদের দাবি করে সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করেছে মিয়ানমার। পাশাপাশি অস্ত্র উঁচিয়ে রোহিঙ্গাদের হুমকি দিচ্ছেন বিজিপি সদস্যরা। এ অবস্থায় তুমব্রু সীমান্তে টহল জোরদার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। সোমবার সকাল ৮টা থেকে থেমে থেমে মাইকিং করে তুমব্রু শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের সরে যেতে বলা হচ্ছে। শনিবার থেকে বিজিবি সীমান্তের কাঁটাতার ঘেঁষে মাইকিং ও তাদের টহল বৃদ্ধি করে। ওই দিন থেকেই আতঙ্কে রয়েছেন শূন্যরেখার প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গা। অনেকে ভয়ে তাদের বসতি ফেলে আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। এতে আশপাশের গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানান স্থানীয়রা।

সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, শনিবার সকালে হঠাৎ করে বিজিপির সদস্যরা তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জমির দখল ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে মাইকিং শুরু করে। এ অবস্থায় এখানকার ছয় হাজার নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ নতুন করে বিপাকে পড়েন। অনেকে মিয়ানমারের উপর্যুপরি হুমকিতে নিজেদের বসতঘর ফেলে তুমব্রু খাল সাঁতরিয়ে এপারে চলে আসেন। খালের ওপারে বেশ কয়েকটি ঘর জনমানবশূন্য পড়ে থাকতে দেখা যায়। কোনো কোনোটিতে এখনো দাঁত কামড়ে পড়ে আছে রোহিঙ্গারা। এপারে যারা এসেছেন, তাদের অনেককে নিজেদের সহায়-সম্বল নিয়ে আসতে দেখা যায়। গত আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের মুখে এককাপড়ে চলে এলেও গত আট মাসে সহায়-সম্বলহীন এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজন এখানে দেশি ও আন্তর্জাতিক নানা সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন। তাই মিয়ানমারের বিজিপি ও মগদের হুমকিতে বসতঘরের সব জিনিসপত্র নিয়ে তুমব্রু খালের বাংলাদেশ অংশে অবস্থান নিয়েছে কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার। কাঁটাতারের ওপারে মাইক ও অস্ত্র হাতে দেখা যায় বেশ কয়েকজন বিজিপি সদস্য এবং মিয়ানমারের মগ-মুরংকে। গতকাল বেলা ২টার দিকেও বিজিপিকে মাইকিং করে শূন্যরেখার আতঙ্কিত রোহিঙ্গাদের সরে যেতে বলতে শোনা যায়।

এ সময় তুমব্রু কোনারপাড়া এলাকার খালের এপারে বসে থাকা রোহিঙ্গা নারী আরেফা খাতুন (৬০) কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘খোদা আমাদের আর কত কষ্ট দেবে, আর কতবার বাঁচা-মরার পরীক্ষায় ফেলবে! নিজেদের সাজানো বাড়িঘর ফেলে ছয় মাস আগে এসে এখানে অবস্থান নিয়েছিলাম। আজকে সেই সামান্য ঠাঁইটুকুও হারাতে হয়েছে। এখন কোথায় যাব জানি না।’

একই অসহায়ত্বের কথা জানালেন তুমব্রু শূন্যরেখার বাসিন্দা মহিবুল্লাহ (৩৫)। তিনি বলেন, ‘আট মাস ধরে এ জায়গাটিতে ছিলাম অনেক লড়াই করে। এখান থেকে আমাদের বাড়ি বেশি দূরে নয়। কয়েকটি পাহাড় পার হলেই আমাদের বাড়িঘর দেখা যাবে। তাই কাছাকাছি ছিলাম, যদি কোনো দিন পরিস্থিতি ভালো হয় আমরা সবার আগে বাপ-দাদার ভিটায় গিয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারব সে আশায়। কিন্তু মিয়ানমার বর্ডার পুলিশ ও মগরা আমাদের বারবার হয়রানি করে যাচ্ছে, হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। আমরা অসহায় হয়ে এপাড়ে চলে এসেছি।’

তুমব্রু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ‘তুমব্রু জিরো পয়েন্টের এই রোহিঙ্গারাই বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন আট মাস ধরে। অন্যান্য সীমান্ত দিয়ে যারাই এপারে পার হয়ে এসেছে, তারা ক্যাম্পে ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু এই পাঁচ-ছয় হাজার মানুষ এখনো প্রতিটি মুহূর্ত আতঙ্কে কাটায়। তাদের সঙ্গে এখানকার সাধারণ লোকজনও আতঙ্কে থাকে। এদের ফিরিয়ে নিতে আরও কঠিন চাপ দিতে হবে মিয়ানমারকে।’ এদিকে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মিয়ানমার বিজিপি তাদের সীমান্তে মাইক লাগিয়ে নো ম্যানস ল্যান্ডের তাদের অংশ নিয়ে কথা বলছে। এখানে আমাদের করার কিছু নেই। তারা নিজেদের অংশে ১৪৪ ধারা জারি করল কি করল না তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমরা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছি। যদি তারা আমাদের কোনো সমস্যা তৈরি করে, তাহলে তখনই আমাদের কিছু করার থাকবে। তবে আমরা সার্বক্ষণিক সতর্কাবস্থায় রয়েছি।’

সর্বশেষ খবর