শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

জটে ঝুলছে ফাঁসির আসামিরাও

মামলাজটে ভোগান্তি ৩

আরাফাত মুন্না

জটে ঝুলছে ফাঁসির আসামিরাও

খাদিজা বেগম গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার ফলশী গ্রামের নওশাদ ফকিরের দ্বিতীয় স্ত্রী। নওশাদের প্রথম স্ত্রী তাসলিমা ও তার ছয় মাসের মেয়েকে ২০০৯ সালের ৩০ জানুয়ারি ভোর রাতে হত্যা করা হয়। বিচার শেষে এ মামলায় ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার একটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ে একমাত্র মৃত্যুদন্ড পান আসামি খাদিজা। তার স্বামীকে (পলাতক) দেওয়া হয় সাত বছর। মৃত্যুদন্ডের আদেশ পাওয়ার পর থেকেই খাদিজাকে নেওয়া হয়েছে কারাগারের ‘কনডেম সেলে’।

বিচারিক আদালতের রায়ের পর ২০১৩ সালেই তার মৃত্যুদ- অনুমোদনের জন্য নিয়ম অনুযায়ী মামলাটি ‘ডেথ রেফারেন্স’ মামলা হিসেবে হাই কোর্টে আসে। চলতি বছর তার মামলাটি শুনানি শুরু হওয়ার পর গত রবিবার হাই কোর্ট খাদিজাকে মৃত্যুদন্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছে। তার স্বামী নওশাদকে খালাস দেওয়া হয়েছে রায়ে। এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মনিরুজ্জামান। ফলে বিচার চলাকালীন খাদিজাকে থাকতে হবে কনডেম সেলেই।

এভাবে খাদিজার মতো প্রায় ১ হাজার ৭০০ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি রয়েছে সারা দেশের কারাগারগুলোর কনডেম সেলে। দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১০ সালে কারাগারগুলোতে এ ধরনের আসামি ছিল এক হাজারের কাছাকাছি। ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১২শ। গত ২০ জানুয়ারি প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী কারাগারগুলোতে ফাঁসির আসামি ছিল ১ হাজার ৬৭১ জন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিম্ন আদালতে কাউকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হলে, নিয়ম অনুযায়ী সেই আসামির মৃত্যুদন্ড  অনুমোদনের জন্য মামলাটি হাই কোর্টে পাঠানো হয়। এ ধরনের মামলা ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে পরিচিত। আর      ডেথ রেফারেন্স মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আসামিকে কারাগারের কনডেম সেলে রাখা হয়। আবার হাই কোর্টে একটি ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তি হলে, সেটি আপিল বিভাগে গেলে আসামির  কনডেম সেল বাসের মেয়াদ বাড়তে থাকে। এ কারণে কারাগারে ফাঁসির আসামি বাড়ার সঙ্গে ডেথ রেফারেন্স মামলার বিচারের একটি যোগসূত্র রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি ফাঁসির আদেশ সম্বলিত রায়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এবং বিচার প্রক্রিয়ায় বিলম্বের কারণে বছর গড়াতেই কারাগারে অন্য আসামির মতো বেড়ে যাচ্ছে ফাঁসির আসামির সংখ্যা। আর বিচার বিলম্বের কারণে উচ্চ আদালতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এ সংক্রান্ত ‘ডেথ রেফারেন্স’ মামলার জট। ২০১০ সালে হাই কোর্টে ৫৪২টি ডেথ রেফারেন্স মামলা বিচারাধীন থাকলেও বর্তমানে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭০৭টিতে। সুপ্রিম কোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিগত চার বছর ডেথ রেফারেন্স মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তির হার অনেক কম। ২০১৫ সালে হাই কোর্টে ডেথ রেফারেন্স মামলা এসেছে ১১৪টি। ওই বছর নিষ্পত্তি হয় ৫৮টি। ২০১৬ সালে ডেথ রেফারেন্স মামলা এন্ট্রি হয় ১৬১টি, নিষ্পত্তি হয় ৪৫টি। ২০১৭ সালে ডেথ রেফারেন্স মামলা এন্ট্রি হয় ১৭১টি এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ৬৬টি। ২০১৮ সালে ডেথ রেফারেন্স মামলা এন্ট্রি হয়েছে ১৫৪টি এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ৮৩টি। এভাবে দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তি কম হওয়ায়  দিনে দিনে ডেথ রেফারেন্স মামলা বেড়েছে। বর্তমানে বিচারাধীন ডেথ রেফারেন্স মামলা আছে সাত শতাধিক। এ ধরনের মামলা নিষ্পত্তির জন্য সম্প্রতি প্রধান বিচারপতির নির্দেশে হাই কোর্টে একটি বেঞ্চ বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্তমানে ২০১৩ সালে যেসব মামলা ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাই কোর্টে এসেছে, সেগুলোর শুনানি চলছে। এর ২০১২ সাল পর্যন্ত আসা সব মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডেথ রেফারেন্স মামলা যে সংখ্যক বিচারাধীন আছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের মামলা শুনানির এখতিয়ারসম্পন্ন বেঞ্চ বাড়ানো দরকার, এটি সত্যি। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন দক্ষ বিচারপতি ও ফাঁসির মামলা পরিচালনা করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আরও বিচারক।’ তিনি বলেন, যদি বেঞ্চ বাড়াতে হয়, সে ক্ষেত্রে আরও বিচারপতি দরকার হবে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদন্ডের আদেশ কমে যাচ্ছে, অনেক দেশে মৃত্যুদ- অমানবিক উল্লেখ করে রহিত করা হচ্ছে। কিন্তু এ দেশে বিচারিক আদালতে ঢালাওভাবে ফাঁসির আদেশ হচ্ছে। ফলে আসামিকে দীর্ঘদিন কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে। কনডেম সেলে রাখার ফলে আসামি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, যা কাম্য নয়। তাই যত দ্রুত সম্ভব ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হওয়া সমীচীন।

সর্বশেষ খবর