শিরোনাম
সোমবার, ১৫ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

মূল হোতার সন্ধান মিলল ৪ বছর পর

শতাধিক কোটি টাকা আত্মসাৎ

মাহবুব মমতাজী

অবশেষে সন্ধান মিলল ১৩০ কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ এবং পাচারের দায়ে অভিযুক্ত ফারইস্ট ইসলামী মাল্টি কো-অপারেটিভের চেয়ারম্যান শামীম কবিরের। ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্মকর্তাদের দায়ের করা অন্তত ৩০টি মামলা হলেও শামীমের কোনো হদিস মেলেনি। শামীম মালয়েশিয়া পালিয়ে গেছেন এমন কথা চাউর হলে দুদক কর্মকর্তারা তাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তবে গত ৫ জুলাই জৈন্তাপুরের তৈয়ব আলী ডিগ্রি কলেজের পেছনে একটি বিলাসবহুল বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। জানা গেছে, চার বছর ধরে শামীমকে খুঁজে না পাওয়ায় অর্থ আত্মসাৎ মামলায় ধীরগতি চলে আসে। এক পর্যায়ে ১৭ হাজার ৫৯৯ জনের প্রায় ৮৫ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় দায়ের করা ১৩টি মামলার তদন্তভার চলে যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে। সংস্থাটি গত এক বছরের তদন্তে শামীমের সন্ধান পায় সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শামীম তাদের জানিয়েছেন, সিলেটে দ্বিতীয় বিয়ে করে সেখানেই আত্মগোপনে থাকেন। আর তার আত্মীয়-স্বজনদের কাছে বলেন- তিনি মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। তিনি আত্মসাতের টাকা দিয়ে ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন বলে জানিয়েছেন।

সূত্র জানায়, গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের সময় প্রতি লাখের বিপরীতে আড়াই হাজার টাকা মুনাফা দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। এভাবে ৪ বছরে দ্বিগুণ এবং ৬ বছরে তিনগুণ দেওয়াসহ বিভিন্ন লোভনীয় প্রকল্প খুলে আমানতকারীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হতো। পরবর্তীতে আমানতকারীদের কয়েক মাস লভ্যাংশ দেন তারা। এভাবে কিছুদিন অফিস চালিয়ে আমানতকারীদের লাভ দেব-দিচ্ছি বলে এবং তাদের নামে বিভিন্ন স্থানে প্রকল্প খুলে জায়গা, জমি, প্লট, ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে বলে মিথ্যা তথ্য দিতেন। এভাবে কয়েক বছর প্রলোভন দেখিয়ে সব অফিস গুটিয়ে নিয়ে আত্মগোপন করেন।

যেভাবে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয় : তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে মো. শামীম কবিরের নেতৃত্বে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিল। হাতিয়ে নেওয়া অর্থ দিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লার বিভিন্ন মৌজায় জমি কেনা হয়। ত্রুটিপূর্ণ, ভেজাল জমি কম মূল্যে কিনে গ্রাহকের কাছে অধিক মূল্যের ভাউচার দেখাত। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের রহস্যজনক খরচ ও ভুয়া ভাউচার সৃষ্টি করে অর্থ আত্মসাৎ করে। একপর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির ২৩ কর্মকর্তা গ্রাহকের আমানতের অর্থ ফেরত না দিয়ে ১৩৫ কোটি ৬৭ লাখ ২৭ হাজার ১৩৮ টাকা ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর এবং আত্মসাৎ করে।

তদন্তের সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকা সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আবু সাঈদ এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, কয়েকটি স্থানে শামীমের বিপুল পরিমাণ সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। সেসব সম্পদের এবং আত্মসাতের টাকাগুলো কোথায় কোথায় গেছে সে বিষয়ের অনুসন্ধান চলছে।

সিআইডির তদন্তে থাকা মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লার দাউদকান্দি শাখায় ২১৯ জন আমানতকারীর কাছ থেকে ৪১ লাখ ৭০ হাজার ৯৩৯ টাকা আদায় করে। এসব টাকা ২০১১ সাল থেকে ২০১২ পর্যন্ত আদায় করা হয়। একইভাবে চৌদ্দগ্রাম উপজেলার খিরনশাল শাখায় এক হাজার ২২০ জনের কাছ থেকে আদায় করা হয় ৩ কোটি ৫৬ লাখ ৭৮ হাজার ১৯৭ টাকা। এসব টাকা ২০০৭ সাল থেকে ২০১২ পর্যন্ত সময়ে আদায় করা হয়। একই উপজেলার মুন্সিরহাট শাখায় এক হাজার ৯১৮ জনের কাছ থেকে ১০ কোটি ৮০ লাখ ৪৪ হাজার ৮৩৯ টাকা আদায় করা হয়। এসবও ২০০৭ সাল থেকে ২০১২ পর্যন্ত সময়কালের। কাশীনগর নামে আরেক শাখায় এক হাজার ১৭৫ জনের কাছ থেকে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৩৭ হাজার ৬০১ টাকা আদায় করা হয়। চৌদ্দগ্রাম বাজার শাখায় এক হাজার ১৭৮ জনের কাছ থেকে ৩ কোটি ২৫ লাখ ৬৪ হাজার ৮২৯ টাকা আদায় করা হয়। কাদৈরবাজার শাখায় ২ হাজার ৯৩৫ জনের কাছ থেকে ১৪ কোটি ৫৩ লাখ ২৫ হাজার ৭১৬ টাকা আদায় করা হয়। লাকসাম উপজেলা শাখায় এক হাজার ৬৫৭ জনের কাছ থেকে ৮ কোটি ১১ লাখ ১৯ হাজার ৯০৫ টাকা আদায় করা হয়। নাঙ্গলকোট উপজেলার বাংগড্ডা শাখায় ৪৯৩ জনের কাছ থেকে এক কোটি ৬২ লাখ ৬৭ হাজার ৫১১ টাকা আদায় করা হয়। মনোহরগঞ্জ উপজেলার নাথেরপেটুয়া শাখায় ৯৫৪ জনের কাছ থেকে ২ কোটি ২৬ লাখ ৮৭ হাজার ৭৩৫ টাকা আদায় করা হয়। ২০১১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শহর শাখায় ৩৪১ জনের কাছ থেকে ৪ কোটি ৮৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কুমিল্লা বিশ্বরোড পদুয়া বাজার শাখায় এক হাজার ৯৯২ জনের কাছ থেকে ১১ কোটি ২৮ লাখ ৯৯ হাজার ৬৬৬ টাকা আদায় করা হয়। একই সময়ে সদর দক্ষিণ উপজেলার ভুশ্চি শাখায় এক হাজার ৮৮৪ জনের কাছ থেকে ১০ কোটি ১৫ লাখ ৮৯ হাজার ৮৭৪ টাকা আদায় করা হয়। গৈয়ারভাঙ্গা শাখায় এক হাজার ৬৩৩ জনের কাছ থেকে ৭ কোটি ৭১ লাখ ৩৮ হাজার ৭৬২ টাকা আদায় করা হয়।

সর্বশেষ খবর