এক অখ্যাত লেখিকার তিনটি ছড়াগ্রন্থ ও আরেক কবির ‘অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ নামক একটি বই নিয়ে এখন সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এ দুই লেখকের চারটি গ্রন্থ বাধ্যতামূলক কিনে সংরক্ষণ করতে সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মহাপরিচালক ও পরিচালকরা চিঠির মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। এর একটি হচ্ছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতর এবং অন্যটি মহিলাবিষয়ক অধিদফতর। কিন্তু কীভাবে ওই দুই লেখকের চারটি বই কিনে সংরক্ষণের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে তা দুটি অধিদফতরের অনেক কর্মকর্তাই জানেন না।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মনজুর কাদের গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, তার দফতর থেকে কীভাবে মৌসুমি মৌ-এর ছড়ার বই কেনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। ওই লেখিকাকেও তিনি চেনেন না। তিনি জানান, তিনি এ-সংক্রান্ত নথি তলব করেছেন। সব দেখে বই কেনার নির্দেশনা বাতিল করবেন বলেও জানান তিনি। সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতর থেকে মৌসুমি মৌ নামে এক কবির তিনটি ছড়ার গ্রন্থ ‘বাংলা ছেড়ে ভাগ’, ‘রামছাগলের পাঠশালা’ ও ‘জাগরণ আসবেই’ এবং কুমার সুশান্ত সরকার নামে আরেক কবির লেখা ‘অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধু ও সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ নামে একটি বইটি কিনে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করে একটি পত্র দেওয়া হয় গত ৭ জুলাই। অধিদফতরের পরিচালক ও যুগ্মসচিব (পলিসি ও অপারেশন) স্বাক্ষরিত ওই চিঠিটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষার বিভাগীয় উপপরিচালক, সব জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, সুপারিনটেনডেন্ট (সব) ও থানা/উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে (সব) পাঠানো হয়। এরপর প্রায় সারা দেশেই এ দুই কবির চারটি বই কমিশন ছাড়াই গায়ের মূল্যে কেনেন সংশ্লিষ্টরা। একইভাবে গত বছরের ২০ নভেম্বর মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের পরিচালক (যুগ্মসচিব) মো. আতাউর রহমান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দেশের সব জেলার মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়; যাতে নির্দেশনা দেওয়া হয় কুমার সুশান্ত সরকারের ‘অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ ও ‘নারী যখন প্রতিবাদী’ বই দুটি কিনে বইয়ের কমপক্ষে ১০টি করে কপি জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা এবং উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে সংরক্ষণ করার জন্য। এ চিঠি পাওয়ার পর দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা মহিলাবিষয়ক অধিদফতরে বই দুটির ১০টি করে কপি সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ বই সম্পর্কে জানতে চাইলে মৌলভীবাজার জেলার একটি উপজেলার মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা গতকাল বলেন, ‘বইয়ের মান নিয়ে আর কী বলব, এগুলো কীভাবে কেনা হয়েছে তা আপনিও জানেন আমিও জানি। ব্যাক ডোর দিয়ে...।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ দুই কবির পরিচিতি সম্পর্কে কেউই কিছু জানেন না। মজার বিষয় হচ্ছে, কুমার সুশান্ত সরকার নামে যে কবির দুটি বই মহিলাবিষয়ক অধিদফতর ও একটি বই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতর কেনার নির্দেশনা দিয়েছে সেই কবির কোনো পরিচিতিই তার বইয়ে নেই। সাধারণত লেখকদের সম্পর্কে জানতে বইয়ের শেষ পৃষ্ঠার মলাটে (ফ্ল্যাপে) লেখকের পরিচিতি তুলে ধরা হয়। তিনি কোথায় জন্মগ্রহণ করেছেন, লেখা পড়া কী এসব তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু কুমার সুশান্তের বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা আছে প্রথাবিরোধী কবি। তার পরের লাইনে রয়েছে বিতর্কিত দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তান হাইকমিশনের একটি বিবৃতি ও এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ক্ষোভ প্রকাশ করে দেওয়া পাল্টা বিবৃতি; যা কোনোভাবেই হওয়ার কথা নয়। কুমার সুশান্তের লেখা ‘অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইটি সংগ্রহ করে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের একুশে বইমেলায় এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ওই বছর ২৬ মার্চ দ্বিতীয় মুদ্রণ হয়, এরপর তৃতীয় মুদ্রণ হয় অক্টোবরে। আর চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, অষ্টম, নবম ও দশম মুদ্রণ হয় গত বছরের ডিসেম্বর মাসে। বইটির গায়ের মূল্য হচ্ছে ৩৩৫ টাকা। প্রকাশক পার্ল পাবলিকেশন্স। মজার বিষয় হচ্ছে, এত জনপ্রিয় বই হলেও বাজারে এর নাম কেউ শোনেনি! আর মৌসুমি মৌ-এর বইগুলো অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে জাগরণ আসবেই বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, তার এ বইটির প্রকাশক শিশুরাজ্য প্রকাশন। ২০১৭ সালের একুশে বইমেলায় বইটি প্রকাশিত হয়। রকমারি ডটকমে বইটি পাওয়া যাচ্ছে বলা হলেও অনেক চেষ্টা করেও সেখানে মৌ-এর কোনো বই পাওয়া যায়নি।