মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের স্রোত শেয়ারবাজারে

রুহুল আমিন রাসেল

অপ্রদর্শিত আয়ের বিনিয়োগ বাড়ছে শেয়ারবাজারে। জানা গেছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে দায়মুক্তি সুবিধা পেয়ে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছেন করদাতারা। পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সরকার অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের যে বিশেষ সুযোগ দিয়েছে তাতে সাড়া মিলেছে। শেয়ারবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ বাড়ায় খুশি অংশীজনেরাও।

এ প্রসঙ্গে খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অপ্রদর্শিত অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ছে। তবে সে বিনিয়োগ এখনো প্রত্যাশা পূরণ করেনি। কারণ বাজারে ভালো শেয়ার নেই। আবার ভালো শেয়ার আনতে প্রণোদনা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে করপোরেট করহার কমানো জরুরি। সারা বিশ্বেই করপোরেট করহার কমছে।’

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-এর পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, ‘শেয়ারবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগে জোয়ার এসেছে। গতি ফিরেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রধানমন্ত্রী এ সুবিধা দিয়েছেন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিনিয়োগের জন্য। অপ্রদর্শিত অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের এ সুবিধা আগামীতে আরও বাড়বে। সরকার আরও সুযোগ-সুবিধা দেবে।’ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর সদস্য (কর প্রশাসন ও মানবসম্পদ) হাফিজ আহমেদ মুর্শেদের মতে ‘করদাতাদের রিটার্নের গতি-প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বেশি অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ হয়েছে। এখনো বড় বড় করদাতা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। ফলে আরও প্রচুর অর্থ মূলধারায় আসবে।’ এদিকে ‘দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না’ বলে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে আইনি নির্দেশনা পেয়ে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শনের রেকর্ড গড়েছেন করদাতারা। এনবিআর চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস বা গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের ব্যক্তি-শ্রেণির করদাতার আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন দাখিলের তথ্য প্রকাশ করেছে। এনবিআরের সর্বশেষ হিসাবে দেশের ব্যক্তি-শ্রেণির ৭ হাজার ৪৪৫ করদাতা তাদের বার্ষিক আয়কর বিবরণীতে অপ্রদর্শিত আয়ের ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা প্রদর্শন করেছেন। বিপরীতে এসব করদাতা সরকারি কোষাগারে আয়কর পরিশোধ করেছেন প্রায় ৯৩৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা; যা অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শনের ইতিহাসে রেকর্ড হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

এবারের বাজেটে অর্থবিলের মাধ্যমে আয়কর অধ্যাদেশ সংশোধন করে নতুন দুটি ধারা যুক্ত করা হয়। ১৯এএএএ ধারায় ১০ শতাংশ কর দিয়ে শেয়ারবাজারে অপ্রদর্শিত বিনিয়োগ রিটার্নে দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়। সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অনুমোদিত ও তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্টক, শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, বন্ড, ডিবেঞ্চার ও অন্য সিকিউরিটিজ এবং শেয়ারবাজারে ক্রয়-বিক্রয় যোগ্য সব সরকারি সিকিউরিটিজ ও বন্ডে এ সুযোগ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে শর্ত দেওয়া হয়, ঘোষণা দেওয়ার পর এক বছর বিনিয়োগকৃত অর্থ শেয়ারবাজার থেকে ওঠানো যাবে না। একইভাবে একই হারে কর দিয়ে ১৯এএএএএ ধারায় জমি-ফ্ল্যাট ও নগদ অর্থ প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়। অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে ১৯ই ধারার মাধ্যমে নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় সাদা করার বৈধতা দিয়ে রেখেছে এনবিআর। এবার শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করার সুযোগ দেওয়ায় একে ‘বিশেষ সুবিধা’ বলা হচ্ছে। এনবিআরসূত্র বলেছেন, আয়কর অধ্যাদেশ ১৯-এর এএএএ ধারা অনুযায়ী ২৫২ জন করদাতা প্রায় ২২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা কর পরিশোধ করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করেছেন। তারা ২৬২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ দেখিয়েছেন। এ থেকে সরকার আয়কর পেয়েছে ২৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এনবিআরের অধীন ৩১টি কর অঞ্চলের মধ্যে শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ বৈধ করেছেন ঢাকার কর অঞ্চল-১ ও ৪-এর করদাতারা। এর পরের অবস্থানে আছেন যথাক্রমে সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও বগুড়া অঞ্চলের করদাতারা। এ ছাড়া ১৯-এর এএএএএ ধারা অনুযায়ী ৭ হাজার ৪৪৫ জন করদাতা প্রায় ৯৩৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা আয়কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শন করেছেন। ফলে দেশের ফরমাল ইকোনমি বা আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে প্রায় ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা প্রবেশ করেছে; যা বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও কর জিডিপির হার বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছে এনবিআর। করদাতাদের জন্য আয়কর অধ্যাদেশের ১৯এএএএ ও ১৯ এএএএএ-এর মাধ্যমে কর পরিশোধের সুযোগ ৩০ জুন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে থাকা আইনি নির্দেশনা অনুযায়ী করদাতাদের অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে জমি, ফ্ল্যাট, বিল্ডিং ও অ্যাপার্টমেন্ট, ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র, শেয়ারবাজার, বন্ড বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজে। এ সুবিধা নিতে ১০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে। এতে নেই কোনো জরিমানা। প্রসঙ্গত, দেশে এ পর্যন্ত ১৭ বার অপ্রদর্শিত অর্থ মূলধারায় আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা প্রদর্শিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি টাকা সাদা হয়েছে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে। ওই সময় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ সুযোগ নিয়েছিল। তখন ৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা প্রদর্শিত হয়। দেশে প্রথম এ সুবিধা দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৫ সালে সামরিক আইনের আওতায়।

সর্বশেষ খবর