বুধবার, ৭ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার : শফিকুর রহমান, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এসআইবিএল

আমানতকারীদের টাকায় প্রণোদনা পান খেলাপিরা

আলী রিয়াজ

আমানতকারীদের টাকায় প্রণোদনা পান খেলাপিরা

শফিকুর রহমান

ব্যাংকিং খাতে এখনো দৈন্যদশা চলছে। পুরো আর্থিক কাঠামো নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ধরনের আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণের প্রয়োজন, ব্যাংক সেসব মানছে না। গুটিকয় ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে একটি ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে রাজনৈতিক প্রভাব থাকে আর বেসরকারি খাতের ব্যাংকে প্রভাব থাকে পরিচালকদের। যারা পরিচালক তারাই সব সুবিধা ভোগ করেন। প্রণোদনা যখন দেওয়া হয় তখন গ্রাহক হিসেবে হাজির হন মূলত ব্যাংকের মালিকরাই। ক্ষুদ্র আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকার সব প্রণোদনা দেওয়া হয় ঋণখেলাপিদের। আর আমানতকারীরা পান না কিছুই। এ অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা থেকে এখনো বের হওয়ার সময় আছে। সরকারের উচিত নিয়ম-নীতির মধ্যে আনতে অভিজ্ঞ ব্যাংকারদের নিয়ে সংস্কার কমিশন গঠন করা। কোনো উদ্যোগ না নিলে আমাদের কাক্সিক্ষত উন্নয়নের যে গল্প সেটি বাস্তবায়ন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। বিশিষ্ট ব্যাংকার বেসরকারি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শফিকুর রহমান ব্যাংকিং নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারে শফিকুর রহমান নিজের ব্যাংকিং কর্মজীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথাও বলেছেন। এ খাতের কোন সংকটের কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায় সেসব বিষয় নিয়ে তিনি নানা মন্তব্য করেন। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে কর্মজীবন শুরু করে জিএম পদমর্যাদায় উন্নীত হওয়ার পর যোগদান করেন এসআইবিএলে। সেখানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিজের কর্মজীবন শেষ করেন তিনি। শফিকুর রহমান বলেন, কভিড সংকটের সময় দেশের শিল্প খাতের পরিস্থিতি আমরা দেখেছি। কয়েক দশক ধরে ব্যবসা করে এসেছেন গার্মেন্ট মালিকরা। যখন উৎপাদন বন্ধ করতে হলো, এক মাসের মধ্যে তারা কেউ শ্রমিকদের বেতন দিতে পারলেন না। তাদের কাছে টাকা ছিল না, এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। গার্মেন্ট মালিকরা বিশেষ সুবিধা নেওয়ার আশায় নানা ধরনের সমস্যার কথা বলেছেন। যারা গার্মেন্ট মালিক তারাই ব্যাংকের মালিক। মালিক হলেও ব্যাংকে তাদের কোনো টাকা নেই। ব্যাংকের টাকা সব আমানতকারীদের। আমানতকারীদের মুনাফার হার কমিয়ে ঋণগ্রহীতাদের নানা ধরনের সুবিধার কথা ঘোষণা করা হলো। তারা বিভিন্নভাবে প্রণোদনা পেলেন। তিনি বলেন, কভিড সংকটের শুরু থেকেই ঋণের কিস্তি জমা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হলো। ঋণের কিস্তি বন্ধ করার এ সুযোগের কোনো প্রয়োজন ছিল না। যারা খেলাপি ছিলেন অতীতে, এ সুযোগের কারণে যারা টাকা দিতে পারতেন, তারাও টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন কারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি আর কারা অনিচ্ছাকৃত খেলাপি সেটি চিহ্নিত করার কোনো পদ্ধতি আর নেই। যদি এসব সুযোগ না দিয়ে বছর শেষে গ্রাহকদের সক্ষমতা বিবেচনায় সুবিধা দেওয়া হতো, তাহলে ভালো গ্রাহকরা সুবিধা পেতেন। বিশিষ্ট এ ব্যাংকার বলেন, ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করেন যে খেলাপিরা, তাদের জন্য সব সুবিধা উজাড় করে দেওয়া হয়েছে। যারা ব্যাংক চালান, নিজেদের মালিক মনে করেন, তারা ব্যাংক ব্যবস্থাকে পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। কিছু বেসরকারি ব্যাংক আছে, যেখানে চেয়ারম্যানের কথা ছাড়া কোনো ব্যাংকিং হয় না। কাজের পরিধি নির্ধারিত না থাকলে যা হয় তা-ই হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি থাকার কথা ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই স্বতন্ত্র স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যার প্রভাব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে আমরা দেখি। সেখানে একসময় সিনিয়র রাজনৈতিক নেতারা পরিচালক হিসেবে থাকতেন। সচিব মর্যাদার কর্মকর্তারাও থাকতেন। ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে পরিচালক হিসেবে নিয়ে আসা হয়েছিল ছাত্রনেতাদের, যাদের না ছিল অভিজ্ঞতা, না ছিল অতীত সম্পর্কে কোনো ধারণা। যার পরিণতি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ভোগ করছে। এসআইবিএল ব্যাংকের সাবেক এ এমডি বলেন, সরকার দুই বছর আগে ঘোষণা দিল খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না। কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ বাড়েনি। সেটি এক ধরনের চাতুর্য। সব খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে দিলে তো খেলাপি থাকবে না। এমনকি যদি সব ঋণ মাফ করে দেওয়া হয় তাহলে কোনো ঋণই থাকবে না। এসব চাতুর্যপূর্ণ ঘটনা আমাদের ব্যাংকিং খাত নয়, পুরো আর্থিক খাতকে পঙ্গু করে দেবে। তিনি বলেন, কৃষি, রেমিট্যান্সের কারণে আমাদের অর্থনীতির শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যে কৃষক উৎপাদন করে দেশের অর্থনীতি সচল রেখেছেন, তাদের জন্য কোনো কিছুই আমরা করছি না। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের মোট ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি কৃষক। নানা ধরনের কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এ ঘটনা ঘটেছে। যারা আক্রান্ত হলেন তাদের চিকিৎসার জন্য সরকার বা রাষ্ট্র কিছু করেছে? কিন্তু যারা ব্যাংকের টাকা নিয়ে পাচার করে দিল তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হলো। কারও বিচারের জন্য কোনো শব্দ পর্যন্ত উচ্চারিত হয় না। কোনো খেলাপি যদি হাই কোর্টে রিট করেন তার আর টাকা ফেরত দেওয়ার দরকার হয় না। কিন্তু একজন কৃষক মাত্র ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে না পারলে তার থাকার কোনো উপায় নেই। তিনি বলেন, সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। কাঠামো ঠিকঠাক না থাকলেও অর্থনীতির উন্নতি হয়েছে। কারণ আগেই বলেছি, এ অর্থনীতির জোরে আমরা বেঁচে আছি। এখন আন্তরিকতার সঙ্গে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট দিয়ে ব্যাংকিং খাতে হাত দিতে হবে। যারা বিদগ্ধ অর্থনীতিবিদ আছেন, ব্যাংকার আছেন, তাদের নিয়ে বিশেষ সংস্কার কমিশন গঠন করা উচিত। গত শতকের শেষ দিকে একটি কমিশন হয়েছিল। তাদের অনেক সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি। নতুন কমিশন গঠন করে সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে বিশ্ব অর্থনীতিতে আমাদের ব্যাংকব্যবস্থা ভূমিকা রাখতে পারবে।

সর্বশেষ খবর