বেলালের ভালোবাসার কথা শুনতে চান না ফারজানা। তিনি নিজেই বলা শুরু করেন। চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘এভাবে ভালোবাসা হয় না। সুন্দরী প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ শূন্য হাতে। এগুলো আমি পছন্দ করি না।’ এমন কথা শুনে বড় ধরনের ধাক্কা খান বেলাল। ফারজানাকে আশ্বস্ত করে বেলাল বলেন, আমি এরপর আসার সময় উপহার নিয়ে আসব। ফারজানা আর কথা বলতে চান না। বাসায় যেতে হবে-বলেই লেক থেকে হন হন করে বেরিয়ে যান। যাওয়ার আগে বলেন, সোনার চেইন ছাড়া আসবা না দেখা করতে। হতাশ বেলাল বসে থাকেন। যা আয় করেন, তাতে সারা মাস ঠিকমতো চলে না তার। সোনার চেইন কোথা থেকে দেবেন? প্রেমিকার এমন দাবি-দাওয়ার মধ্য দিয়েই চলছিল ভালোবাসা। কী করবে, ভেবে পায় না বেলাল। এর মধ্যেই বেলালের খালাতো ভাই শাহ আলমের পরিবারে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যায়। চট্টগ্রামে নতুন আসার পর বেলাল তার এই ব্যবসায়ী খালাতো ভাই শাহ আলমের বাসায় উঠেছিলেন। সেখানেই আড়াই বছর। সেই শাহ আলমের স্ত্রী নাছিমা বেগম আর ১০ বছরের মেয়েকে দুর্বৃত্তরা জবাই করে হত্যা করেছে। লুটে নিয়ে গেছে স্বর্ণালঙ্কার, নাছিমার ব্যবহƒত দুটি মোবাইল ফোন সেট ও নগদ টাকা। খুনের ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর সবার মতো বেলালও ছুটে যায় বাসায়। চট্টগ্রামের সদরঘাট এলাকার দক্ষিণ নালাপাড়ার ছয়তলা ভবনের চারতলায় থাকেন শাহ আলম। ২০১৫ সালের ৭ মের সকালেই সেই বাসায় এই মর্মন্তুদ ঘটনাটি ঘটে। পুলিশ ঘটনাস্থলে। বেডরুমে পড়ে আছে বেলালের ভাবি নাছিমা বেগমের রক্তাক্ত লাশ। তাকে জবাই করা ছাড়াও পেটে ও হাতে বেশ কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ১০ বছরের শিশু সন্তান রিয়া আক্তার ফাল্গুনীর লাশ পড়ে আছে বাসার বাথরুমের ভিতর। তাকেও জবাই করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পুরো বাসা যেন রক্তে ভাসছিল। বাসার মালামাল ছিল ওলটপালট। আলমারি ছিল খোলা। শাহ আলম তার স্ত্রী কন্যাকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। ভাতিজির লাশ ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন ১৯ বছরের বেলাল।
পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, ডাকাতদের কাজ এটা। কিন্তু শিশু রিয়াকে হত্যা করায় ডাকাতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ডাকাতি নিয়ে সন্দেহ। যে কারণে পুলিশ ডাকাতির বিষয়টিও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না। পুলিশ এও ভাবছে, খুব কাছের লোকজন এ ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে। পুলিশের সন্দেহের তীর প্রথমেই যায় রিয়ার গৃহশিক্ষক রকির দিকে। রকির সঙ্গে শাহ আলমের স্ত্রীর বিশেষ সম্পর্ক ছিল। এটি পুলিশ জানতে পেরেছে। বেলালও বিষয়টি জানতেন। পুলিশের জেরার মুখে বেলাল তা পুলিশকে জানিয়েছেন। তার ভাবি নাছিমা বেগম তাকে সহ্য করতে পারতেন না। গৃহশিক্ষক রকির সঙ্গে ভাবির অন্তরঙ্গ মুহূর্ত দেখে ফেলেছিলেন এক দিন। যে কারণে বেলাল বাসায় গেলেই অকথ্য ভাষায় বকাঝকা করতেন নাছিমা। চট্টগ্রামে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা এই মা-মেয়ে খুনের ঘটনায় রকিসহ পাঁচজনকে আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদে খুন সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্যই পায় না পুলিশ। তবে রকিকে পুলিশ নজরে রাখে। রহস্যই থেকে যায় খুনের পুরো বিষয়। নাছিমার মোবাইল ফোন একটিবারের জন্যও খোলা পাওয়া যায়নি। যে কারণে প্রযুক্তির ব্যবহারও কাজে লাগাতে পারছে না পুলিশ। মাঝেমধ্যে গোয়েন্দা দফতরে ডেকে পাঠানো হয় বেলাল ও শাহ আলমকে। নতুন কোনো তথ্য বা কাউকে সন্দেহ করছে কি না, তা জানতে চায় পুলিশ। কিন্তু তারা কোনো তথ্য দিতে পারেন না। পুলিশ বেশ চাপের মধ্যে পড়ে। শাহ আলম শোক কাটিয়ে ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। বেলাল আর ফারজানার প্রেম চলতে থাকে আগের মতোই। তবে বেলাল তার প্রেমিকা ফারজানার দাবি-দাওয়া মেটাতে থাকেন। ফারজানাকে সোনার চেইন উপহার দিয়েছেন। চেইন পাওয়ার পর ফারজানার দাবি ছিল টিভি, ডিভিডি, মোবাইল ফোন, স্পিকারের। এগুলো না হলে ফারজানার পরিবার তার সঙ্গে বিয়ে দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল। ফারজানার এসব দাবিও পূরণ করেছেন বেলাল। বেলাল তার প্রেমিকাকে নিয়ে ভালো আছেন। কিন্তু ফারজানার দাবি দিন দিন বাড়তে থাকে।
খুনের ১৭ দিন পর নাছিমার মোবাইল ফোন খোলা পাওয়া যায়। ফোনটি কেউ খুলে ১৯ সেকেন্ড কথা বলে আবারও বন্ধ করে দেয়। পুলিশ মোবাইল ফোনের সেই ১৯ সেকেন্ড কলের তথ্যে তদন্তে নতুন মাত্রা পায়। শুরু হয় ট্র্যাকিং। একপর্যায়ে পুলিশ ফোনের কাছাকাছি। মোবাইল সেটের আইএমই নম্বর নিয়ে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুলিশ ফোনের মালিককে পাকড়াও করে। সে পুলিশকে বলে, মোবাইল ফোনটি দিয়েছে তার বন্ধু রুবেল। পুলিশ দ্রুত রুবেলের বাসায় হাজির। রুবেল আটক হয়। পুলিশের জেরায় রুবেল বলে, মোবাইল সেটটি তাকে দিয়েছে আপন বোন ফারজানা। তদন্তে নতুন মোড়। পুলিশ ফারজানার সন্ধান করে। সেদিনই ফারজানাকে আটক করা হয় তার বাসা থেকে। পুলিশ ফারজানাকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। রাতভর জিজ্ঞাসাবাদে সে বলে, মোবাইল ফোনটি তার বয়ফ্রেন্ড গিফট করেছে। বয়ফ্রেন্ডের নাম বলুন? পুলিশের এমন প্রশ্নে ফারজানা বলে, আমার বয়ফ্রেন্ডের নাম বেলাল। পুলিশ বেলালের সন্ধান চায়। ফারজানা বেলালের ফোন নম্বর দেয়। পুলিশ কর্মকর্তা নিজের মোবাইল ফোনে নম্বর উঠিয়ে কল দেন। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে বেলাল নামটি ভেসে ওঠে। পুলিশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। দ্রুত লাইন নিজেই কেটে দেন। কী ব্যাপার! নম্বরটা সেভ করা কেন? এটা কোন বেলালের নম্বর। পুলিশ কর্মকর্তার মাথায় তখন শুধু বেলাল। হঠাৎ তার মনে পড়ল নিহত নাছিমার দেবরের নাম বেলাল। তবে কী এই বেলাল সেই বেলাল! এক বেলালের নাম শুনেই ভ্যাবাচ্যাকা খায় পুলিশ। হিসাব মেলাতে পারছে না কেউ। বেলালের ব্যাপারে পুলিশ আরও শিওর হয় ফারজানার কাছে। ফারজানার কাছ থেকে নিয়ে বেলালের ফোন নম্বর মিলিয়ে দেখে পুলিশ। পুলিশ এবার নিশ্চিত। খুনি তাহলে আর কেউ নয়, বেলাল! ফারজানা আরও জানায়, তার চাপেই বেলাল তাকে টিভি, সাউন্ডবক্স, ডিভিডি, সোনার চেইন উপহার দিয়েছে। পুলিশ এবার বেলালকে গ্রেফতারে প্রস্তুতি নেয়। খুনের ১৯ দিনের মাথায় পুলিশ বেলালকে ফোন দেয়। বেলাল আসছি বলে আর বেশি সময় নেয়নি। কিছু সময়ের মধ্যেই হাজির হয় গোয়েন্দা দফতরে। খুনের ১৯ দিন পর মোবাইল ফোনের ১৯ সেকেন্ডের কলের জালেই ধরা পড়ে খুনি। খুনের রহস্য উন্মোচিত হয়। পুলিশ বেলালকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। বেলাল পুলিশকে জানান, ‘আমি সব জানি। ফারজানা, তার ভাইসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তা আমি শুনেছি। আমি পালিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু আমি এটাও জানি, বাংলাদেশের যে প্রান্তেই থাকি না কেন, পুলিশ আমাকে ধরবেই। তাই পালিয়ে গিয়ে লাভ কী। আমি জানি, আমি অপরাধ করেছি। শাস্তি আমার হবেই।’ বেলাল আরও বলেন, ‘মায়ার জালে পড়ে আজ আমার এই অবস্থা। কেউ যেন এমন নারীর রোষানলে না পড়ে। তার দাবি ছিল পুলিশের কাছে, ফারজানার শাস্তিও যেন হয়। বেলাল পুলিশের কাছে পুরো ঘটনার বর্ণনা করেন। চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি এখন কারাগারে।
খুনের বর্ণনা দিয়ে বেলাল পুলিশকে বলেন, ‘ভাইয়ার (শাহ আলম) মাংসের দোকানে তার শ্যালক আলালের সঙ্গে আগে কাজ করতাম এবং তাদের বাসায় খেতাম ও ঘুমাতাম। পরবর্তীতে মুনস্টার রং ফ্যাক্টরির পাশে একটি জেনারেটরের দোকানে ৮ হাজার টাকায় মিস্ত্রি হিসেবে কাজ নিলে ভাইয়ের বাসা থেকে চলি আসি। তবে মাঝেমধ্যে বাসায় যেতাম এবং খাওয়া-দাওয়া করে আসতাম। ঘটনার দুই দিন আগেও ভাইয়ের বাসার ফ্যান মেরামত করতে গেলে সেখানে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। পরের দিন সকালে আমার কাজে চলে আসি।’ কিন্তু প্রেমিকা ফারজানার চাপে আমি দিশাহারা হয়ে পড়ি। উপহারসামগ্রী না দিলে তাকে পাব না। এটা আমাকে কষ্ট দিচ্ছিল। টাকা কোথায় পাই তা মাথায় ঘুরছিল। এক সময় মাথায় ঢুকে নাছিমা ভাবির কথা। আমি জানতাম আলমারিতে টাকা আছে। এরপর ৭ মে একটি কালো প্যান্ট ও কালো শার্ট গায়ে দিয়ে ভাইয়ের বাসার আশপাশে অবস্থান নিই। ভাইয়া ও তার শ্যালক বাসার বাইরে গেলে আমি বাসায় ঢুকি। এ সময় ভাবি আমাকে দেখে খুবই উত্তেজিত হয়ে যান। আমি এমনিতেই তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলাম। চিৎকার শুনে মাথা অস্থির হয়ে যায়। এ সময় হাতের কাছে থাকা ছুরি দিয়ে তার পেটে আঘাত করি। চিৎকার দিলে তাকে মেঝেতে ফেলে ধরে গায়ের ওপর উঠে গলা কেটে হত্যা করি। এ সময় পাশের রুমে ঘুমিয়ে থাকা রিয়া আমার কাছে এসে কান্নাকাটি শুরু করে। চিনে ফেলায় তাকেও বাথরুমে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করি। এরপর বাথরুমে ঢুকে পরিষ্কার হয়ে মনোহরখালী সাততলা মাঠে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেই। ভাবির ব্যবহƒত মোবাইল ফোন সেট দুটি ফারজানাকে গিফট করি। এর মধ্যে খুনের পর স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করা টাকা ও আলমারি থেকে নেওয়া টাকা দিয়ে একটি টিভি, ডিভিডি প্লেয়ার ও ২টি সাউন্ডবক্স কিনে গিফট করি ফারজানাকে।